সোনার কেল্লা

তানজিনা হোসেন

বাইরের দৃশ্য অদ্ভুত। মাইলের পর মাইল অল্প ঢেউ খেলানো জমি দেখা যাচ্ছে দুদিকে-তার মধ্যে একটা বাড়ি নেই, একটা লোক নেই, একটা গাছ পর্যন্ত নেই। . . . . থাইয়ৎ হামিরা স্টেশন পেরোনোর কিছু ক্ষণ পরেই দূরে আবছা একটা পাহাড় চোখে পড়ল। এই সেই রাজস্থানি চ্যাপটা টেবল মাউন্টেন। আমাদের ট্রেনটা মনে হল সেই পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে। আটটা নাগাদ মনে হল পাহাড়ের ওপর একটা কিছু রয়েছে। ক্রমে বুঝতে পারলাম, সেটা একটা কেল্লা। সমস্ত পাহাড়ের উপরটা জুড়ে মুকুটের মতো বসে আছে কেল্লাটা-তার ওপর সোজা গিয়ে পড়েছে ঝকঝকে পরিস্কার সকালের ঝলমলে রোদ। আমার মুখ থেকে একটা কথা আপনা থেকেই বেরিয়ে পড়ল-‘সোনার কেল্লা!’ 

জাতিস্মর রহস্যময় বালক মুকুল আর ফেলুদা-তোপসের সঙ্গে সেই ছোটবেলাতেই মনে মনে কত জয়সালমীর গেছি! যেখানে বিরাট পাগড়ি মাথায় নাক অবধি চাদরে ঢেকে টকটকে লাল জামা পরা লালমোহনবাবুর ভাষায় ‘পাওয়ারফুলি সাসপিসাশ’ রাজস্থানি লোক ইস্টিশনের বেঞ্চিতে পা তুলে বসে থাকে, কিংবা বালি আর সাদা ঝলসানো ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে চলে উটের দল যাদের পিঠে লাল নীল হলদে সবুজ জ্যামিতিক নকশা আঁকা জাজিম বসানো, আর সত্যজিতের ভাষায় ‘সব মিলিয়ে মনে হয় যেন পৃথিবীর কোনও একটা অনাবিস্কৃত জায়গায় এই ট্রেনটা কেমন করে জানি এসে পড়েছে-ঠিক যেমনি করে রকেট গিয়ে হাজির হয় চাঁদে!’ আমরা অবশ্য ট্রেনে নয়, জয়পুর থেকে উঠেছি স্পাইস জেট বিমানে। বিমানের জানালা দিয়ে ক্রমশ উদ্ভাসিত হচ্ছে ধূ ধূ থর মরুভূমি; রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয় আর আতঙ্ক যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। খানিক দূরে দেখা যাচ্ছে তিন পাখা অলা সব বিশাল উইন্ড মিল, বাতাসে তাদের পাখাগুলো অবিরত ঘুরছে। সামনের সিটের তরুণটি ক্যামেরা বের করে বিমানের জানালা দিয়ে আশ্চর্য ধূসর সেই মরুর ছবি তুলতে লাগল। আমার পাশ থেকে যুহায়ের ফিস ফিস করে বলল, মা, আশে পাশেই আছে পোখরান। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ওদের, যেখানে নিউক্লিয়ার উইপন টেস্ট হয়েছিল! জয়সালমীর এয়ারপোর্টে নেমে সত্যি নিরাপত্তার কড়াকড়ি চোখে পড়ল। এই বিমানবন্দরে ছবি টবি তোলা নিষেধ। সেনা সদস্যরা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। আমাদের একদিনের সফরে কোন লাগেজ নেই। হাতের ব্যাগ হাতে তাই গটগট করে বেরিয়ে এসে একটা প্রি পেইড ট্যাক্সি নিলাম। ধুলো উড়িয়ে ট্যাক্সি ছুটে চলল রুক্ষ কঠোর প্রকৃতির মাঝ দিয়ে। দুপুর গড়িয়ে আসছে। ঝকঝকে সোনালি রোদ। গাঢ় নীল মেঘহীন আকাশ। যেন আকাশ ভরা কাঁচা সোনা।

সোনার কেল্লা

আজ থেকে প্রায় সাড়ে আটশ বছর আগের কথা। এই ধূ ধূ প্রান্তরের থর মরুভ‚মিতে ১১৫৬ সালে নগরপত্তন করেন রাওয়াল রাজা জয়সাল। সেই থেকে এ প্রাচীন নগরের নাম জয়সালমীর। মরুভূমির ধূসর হলুদ পাথর বা ইয়েলো স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই নগরের দূর্গ বা কেল্লা। এই কেল্লা শত শত বছর ধরে সেই একই রকম সোনালি রং ছড়িয়ে টিকে আছে, এই রাজপুত গোষ্ঠীর শত বছরের যুদ্ধ, রক্তপাত, জয়-পরাজয় আর বীরত্বের ইতিহাস বুকে নিয়ে। বারো শতকে আরব, মিশর, পারস্য থেকে নানা বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে এই থর পেরিয়েই ভারতে পৌঁছাতেন ব্যবসায়ীরা। অন্তহীন আর বিপদসঙ্কুল ছিল এ পথ। কোথাও পানি বা খাবার নেই, ধূ ধূ মরুভূমি, বালু ঝড় উঠলে ঘন অন্ধকার আর দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে গোটা প্রান্তর, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল যখন তখন হামলা চালায় দস্যুর দল।

এ পথ দিয়ে যাবার সময় প্রায়ই আক্রমণের শিকার হতে হতো ব্যাবসায়ীদের। পথে পথে চাঁদা বা ট্যাক্স বসাতো স্থানীয় রাজারা। কথিত আছে, এরকমই এক আক্রমণের শিকার হয় দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর ক্যারাভান। আলাউদ্দিন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। বাইরে থেকে সব ধরণের খাবার দাবার ও রসদ পৌঁছানো বন্ধ করে দেন দূর্গে। কেল্লা অবরূদ্ধ করে রাখেন প্রায় আট বছর। শেষ অবধি কেল্লার রাজপুত নারীরা সিদ্ধান্ত নেন ইতিহাসের করুণতম এক জোহর বা আত্মাহুতি। চব্বিশ হাজার রাজপুত নারী আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহুতি দেন একদিন। আর চার হাজার রাজপুত বীর রাজপুরুষ কেল্লার বিশাল দরজা খুলে দিয়ে এগিয়ে যান নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি কতটুকু সত্য আর কতটুকু অতিরঞ্জিত তা বলা মুশকিল। তবে সেকালে রাণীদের মধ্যে সতীদাহ বা জোহর প্রথা ভালই প্রচলিত ছিল। রাজার মৃত্যু হলে তার রাণীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন বা জোহর পালন করতেন নিয়মিত। মন্দিরের দরজার পাশে আত্মহুতির আগে একটা হাতের ছাপ রেখে যেতেন তারা। সেই ছোট ছোট হাতের ছাপগুলো পাথরের দেয়ালে আজও রয়ে গেছে। রাজস্থানের পালাগান, পুঁথি আর স্থানীয় গল্প গাঁথায় অমর হয়ে আছে এই সব কাহিনী।

ধূ ধূ মরুভূমি

হোটেল থেকে কেল্লা বেশি দূরে নয়। ছোট্ট শহর জয়সালমীর। শহরটির যে কোন স্থান থেকেই চোখে পড়ে কেল্লাটা। একটা চ্যাপটা পাহাড়ের ওপর, টেবিলের মত বলে যার নাম টেবল মাউন্টেন, তার ওপর সত্যি মুকুটের মতই বসানো কেল্লাটা। কেল্লার পাদদেশে গাড়ি থেকে নেমে সত্যি অভিভুত হবার দশা। সকালবেলার কাঁচা সোনার মত রোদ মরুর বুকে প্রতিফলিত হয়ে সোজা এসে পড়েছে কেল্লার ওপর। একেবারে একটা সোনার মুকুটের মতই ঝলমল করছে গোটা কেল্লা। চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মত। তোপসের মুখ দিয়ে যেমন অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিল কথাটা-সোনার কেল্লা-তেমনই অবস্থা। এত শত বছরেও এর জেল্লা যেন একটুও কমেনি। সোনার কেল্লার মোট চারটে ভারি ভারি গেট। একের পর এক গেট পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় কেল্লায়। বিশ্বের কয়েকটি জীবন্ত দুর্গ বা কেল্লা আছে, মানে যেখানে আজও মানুষের মুখরিত চলাফেরা আর বসবাস, তার একটা উদাহরণ এই কেল্লা। প্রায় চার হাজার মানুষ বাস করে এই কেল্লার ভেতর। একদিকে থাকে পুরোহিত ব্রাহ্মণ গোত্রের লোকেরা, যাদের পূর্বপুরুষ এক সময় রাজাদের পূজা অর্চনার কাজ করতো। আরেকদিকে রাজপুত বংশীয় যোদ্ধাদের উত্তরসূরী। এ জমানায় এই দুই গোত্রের প্রায় সকলেরই জীবিকা ট্যুরিস্টদের কাছে জিনিসপত্র বেচাকেনা বা গাইড হিসেবে কাজ করা। কেল্লার পাথুরে পথে বসে কোথাও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছে পাগড়ি পরা রাজস্থানি গায়ক, কোথাও ছোট শিশুদের পাশে নিয়ে রাজস্থানি পুতুল আর গহনা বিক্রি করছে বুক পর্যন্ত ওড়না দিয়ে ঢাকা নাকছাবি পরা নারীরা, কোথাও সুঠাম দেহের গোঁফঅলা আধুনিক পোশাক পরা তরুণ বিদেশি ট্যুরিস্টদের ছবি তুলে দিচ্ছে। সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখন ট্যুরিস্টদের বদান্যতায়ই দিন গুজরান করে।

মানুষের ভিড় ঠেলে ঠেলেই এগোতে হল। কেল্লার ভেতর রাণীদের প্রাসাদ আর মন্দির ছাড়াও রয়েছে অপূর্ব কারুকাজ করা জৈন মন্দির, কয়েকটি হাভেলি। এগুলোর দেয়ালে ও ছাদে পাথরের ওপর সূক্ষ কারুকাজ যে কাউকে বিস্মিত করবে। সোনালি পাথুরে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম শত শত বছর আগে এই কেল্লার ভেতর এক রাশ ধুলো উড়িয়ে ঢুকতো উটের পাল, তাদের পিঠে বিশাল গোঁফ আর পাগড়ি পরা রাজপুত বীর যোদ্ধা তলোয়ার উঁচিয়ে জয়ীর বেশে প্রবেশ করতো এর অন্দরে, প্রাসাদের সামনে যুদ্ধজয়ের আনন্দে হয়তো বসতো কালবেলিয়া বা ঘুমার নাচের জলসা, ঢোল আর পুঙ্গির আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠতো রাতের মরুভূমি, ঘাঘরা উড়িয়ে ওড়নায় মুখ ঢেকে ঘুরে ঘুরে নাচতো কালবেলিয়া আর জোগি নাচিয়েরা। কাল রাতে এমনই এক কালবেলিয়া গান শুনেছি মরুভূমির বুকে তারা জ্বালা আকাশ আর গোল সাদা চাঁদের আলোর নিচে তাঁবুর সামনে গালিচায় বসে। কালো জমিতে আয়না আর পুঁথি বসানো ঘাঘড়া পরে দুটি মেয়ে নাচতে নাচতে শুনিয়েছিল আবাদী এলাকা থেকে ধূসর মরুতে এসে তাদের জীবন কেমন কাটছে সেই গান।

হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছে পাগড়ি পরা রাজস্থানি গায়ক

সুতীব্র সেই কন্ঠস্বর আর হাহাকার ভরা সূর যেন এখনো কানে বাজছে। ও মা, তুই আমায় বিয়ে দিয়ে পাঠালি এই ধূসর মরুতে/ আমি তো ফেলে এসেছি আমগাছ আর তেঁতুলগাছ ঘেরা এক সবুজ গাঁ/ এখানে বাতাসে ঘূর্ণিপাক দিয়ে ওড়ে বালু/ ও আমার ভাই, লবণের বণিকদের মত আমি এসে পড়েছি এই মরুভূমিতে/ এই বুনো বাবলা গাছের প্রান্তরে! মনে হচ্ছিল যেন মেয়েটার বুক ফাটা হাহাকার মিলে মিশে যাচ্ছে আমার দেশের ভাটির মেয়েটার চোখের জলের সঙ্গে: যদি বন্ধু যাবার চাও, ঘাড়ের গামছা থুয়া যাও বন্ধু কাজল ভ্রমরারে! সঙ্গীতের ভাষা দুনিয়াজুড়ে বুঝি একই। কেল্লার গলি ঘুঁপচির শেষ মাথায় হাত ভর্তি সাদা চুড়ি আর গোলাপি ঘাগরা পরা ভারি মিষ্টি একটা মেয়ে রুপালি মালা বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে-নেবে, নাও না? মেয়েটার দু চোখে মরুর ধূ-ধূ অতলতা, হাসিতে যেন মুক্তো ঝরছে; বললাম-নেব, কিন্তু একটা ছবি তুলব তোমার। অমনি সে কপাল অব্দি ঘোমটা টেনে হেসে দাঁড়াল দরজাটি ধরে। কেল্লার ফটকের কাছে তখনো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে চলেছে পাগড়ি পরা লোকটা; তোমার দু হাত ভরা সাদা শাঁখের চুড়ি, আর তোমার কপালে সোনালি গয়না, সাত বোন যখন তোমার আঙিনায় নাচছে, দেবী, তুমিও তাদের সঙ্গে খেলছো!

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন