শতবর্ষ ধরে গাছের কোটরেই প্রেমালাপ

শাহীদুল ইসলাম

মিন্না। উত্তর জার্মানীর ইউটিন শহরের এই অষ্টাদশী তরুণী প্রেমে পড়েছিলেন উইলহেম নামের এক তরুণের। উইলহেম পেশায় ছিলেন চকলেট প্রস্তুতকারক। ফলে প্রভাবশালী মিন্নার বাব মেয়েকে নিষেধ করেছিলেন উইলহেমের সঙ্গে মেলামেশা করতে। কিন্তু প্রেম কি আর নিষেধ মানে? তাইতো মিন্না-উইলহেম দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করলেও বন্ধ করলো না তাদের মন দেওয়া-নেওয়া। মনের অব্যক্ত কথা আদান-প্রদানে তারা আশ্রয় নিলো চিঠির। আর সেই চিঠি রাখতে শুরু করলা মিন্নার বাড়ির পাশের একটি ওক গাছে।

এভাবেই সংগোপনে মন আদান-প্রদান চললো এক বছর। ঠিক এক বছর পর মিন্নার বাবা সম্পর্ক মেনে নিল। ধুমধাম করে মিন্না-উইলহেমের বিয়ে হল সেই ওক গাছের নিচেই। মিন্না-উইলহেম জুটির প্রেমের উপখ্যান পুরো জার্মানিতেই ছড়িয়ে পড়লো। তাদের প্রেম কাহিনীর সাথে সাথে বিখ্যাত হয়ে উঠলো পরিণয়ে সাহায্য করা ওক গাছটিও। ওপরে যে আবেগঘন প্রেম কাহিনীটি বললাম সেটা আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগেকার। সময়কাল ১৮৯১ সালের ২ জুন। কিন্তু শতবর্ষী এই কাহিনী কিংবদন্তীর মতো আজও জার্মান প্রেমিক -প্রেমিকাদের মুখে মুখে ফেরে। এতগুলো বছর পেরিয়ে এখনও হতাশাগ্রস্থ মানুষেরা এই ওক গাছের ঠিকানায় চিঠি লেখে। কালের আবর্তনে এই ওক গাছটিই হয়ে উঠেছে প্রেম বিড়ম্বিত মানুষের সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার ঠিকানা। আর গাছটি পেয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক পোস্ট বক্সের তকমা। অনেকে একে আদর করে ব্রাইডগ্রুম বা বর-বউ গাছ বলেও ডাকে। 

ব্রাইডগ্রুম ট্রি

ওক গাছটির অবস্থান জার্মানির উত্তরাঞ্চলীয় শহর ইউটিনের দোদেয়ার বনে। গাছটির বয়স প্রায় ৫০০ বছর। গাছটির একটি কোঠর প্রায় ১০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে পোস্ট বক্স হিসেবে। কারণ মিন্না-উইলহেম জুটির গল্প ছড়িয়ে পড়ার অসংখ্য মানুষ চিঠি রাখা শুরু করে ওক গাছের কোঠরে। শুধু প্রেমের চিঠি নয়। নানা ধরনের চিঠি আসতে শুরু করে। ফলে ১৯২৭ সালে জার্মান পোস্টাল বিভাগ একপ্রকার বাধ্য হয়ে এই ওকগাছের জন্য নির্দিষ্ট কোড ও ডাক পিয়ন ঠিক করে। 

৭২ বছর বয়সী কার্ল হেইনজ মার্টেনস তেমনই একজন ডাকপিয়ন। বর্তমানে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন মার্টেনস। ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন চিঠি নিয়ে ছুটে যেতেন দোদেয়ার বনের গাছ ডাক বাক্সটির কাছে। তার ভাষায় দীর্ঘ দুই যুগের কর্মজীবনে এমন ভাষার চিঠিও তার হাতে পড়েছে যে চিঠির ভাষা তার জানাও নেই। অর্থাৎ সারা পৃথিবী থেকে চিঠি আসতো এখানে। মার্টেনেস নিজেও এখান থেকে তার জীবন সঙ্গী খুজে পেয়েছেন। বিয়েও করেছেন এই গাছের তলায়। শুধু মার্টেনেস নয় তার মতো অন্তত একশত বিয়ের সাক্ষী এই গাছ।

প্রায় ১০০ বছর ধরে জার্মান ডিাক পিয়নরা এখানে চিঠি আদান-প্রদান করছে

তবে পৃথিবীর আর দশটা ডাকঘরের চেয়ে এই ডাকঘরের চিঠি আদান-প্রদানের নিয়ম একেবারেই আলাদা। বিশ্বের যে কোন জায়গা থেকে এই গাছের ঠিকানায় চিঠি লেখা যায়। ডাকপিয়ন সেই চিঠি গাছের কোটরে পৌছে দেয়। নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে সেই চিঠি লেখা হয় না। মনের মানুষ খুঁজতে নিজের পছন্দের বিবরণ দিয়ে চিঠি লেখা হয়। সেই চিঠি পড়ে যদি কারো জবাব দিতে ইচ্ছা হয়, তা হলে দেবে আর ভালো না লাগলে সেখানেই রেখে দিতে হবে। শর্ত একটাই, কেউ যদি পছন্দ করে কোন চিঠি নিয়ে যায় তা হলে তাকে অবশ্যই সেই চিঠির জবাব দিতে হবে।

ডাকঘরের লেখা চিঠি কেমন হয় গাছের কোটরে রাখা বেগুনি রঙের একটি খামবদ্ধ চিঠির বিবরণ দিলে বিষয়টি বোধগম্য হবে। লিখেছেন জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের বাসিন্দা ডেনিজ। ডেনিজ তার সংক্ষিপ্ত চিঠিতে লিখেছেন, আমার বয়স ৫৫ এবং আমি নিজেকে নিয়ে হাসতে ভয় পাই না। প্রকৃতিকে ভালোবাসি। আমি জানি আমি কী চাই এবং একাকীত্ব নিয়েও অখুশি নই। তবে আমাকে চমক দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করে এমন একজন মানুষ আমি খুঁজছি। আর একটি চিঠিতে ম্যারি নামের এক নারী এমন একজনকে খুঁজছেন যে কিনা নাচতে পারেন। হেনরিচ একজন ভ্রমণসঙ্গী খুঁজছেন। চীনের সিজিয়াঝুয়াংয়ের লিউ জানতে চান, এমন কোনো জার্মান নারী কি আছেন যিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন চীনা নাগরিককে খুঁজছেন। এরকম হাজারো মানুষ ওক গাছের ঠিকানায় লিখে পাঠান মনের কথা। 

হাজারো চিঠি আসে ওক গাছের ঠিকানায়

এত সঙ্গী ও বিয়ের সাক্ষী যে গাছ তাকে একটি সঙ্গী না খুজে না দিলে সেটা বড়ই বেরসিক ঠেকে। তাইতো ২০০৯ সালে ওক গাছকে ২০০ বছর বয়সী একটি কাঠবাদাম গাছের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। কাঠবাদাম গাছটি ছিল ৫০৩ কিলোমিটার দূরে। অবশ্য ৬ বছর পর কেটে কাঠবাদাম গাছটিকে কেটে ফেলা হয়। ইন্টারনেটের এই যুগে ডাকপিয়নের সেই ব্যস্ততা আর নেই। দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ডাকঘরের সেই বনেদি হাঁকডাক। যে ডাকঘর এক সময় শত সহস্র মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকতো আজ যেন তা ভুতুড়ে বাড়ি। তবে থেমে নেই রোমন্টাটিক ডাকঘরের চিঠি আদান-প্রদান। আজও সেখানে চিঠি লিখে সঙ্গী পাবার জন্য অপেক্ষা করে অনেক ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ। সম্ভবত এই অপেক্ষা থাকবে অনাগত দিনগুলোতেও। 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন