ট্রাভেলগবিডি ডেস্ক
১৯৩১ সালের ৭ জুলাই। সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিটের বাঙালি মসজিদের সামনে তখন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সবাই প্রবাসী ভারতীয় বাঙালী। অধিকাংশের বাড়ি তখনকার বৃটিশ ভারতের আসামের সিলেট জেলায়। চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে আছেন সবাই। কারণ বাঙালীর ছেলে রামানাথ বের হচ্ছে বিশ্বজয়ে। যাত্রায় সম্বল বলতে একটি বাইসাইকেল, দুটো চাদর, এক জোড়া চটি আর সাইকেল মেরামতের সরঞ্জামে ভর্তি একটি বাক্স। সমবেত জনতার সেই বিস্ময় গায়ে মেখে সব সংশয়, সব বাধা উপেক্ষা করে সাইকেলে প্যাডেল মারলেন রামনাথ বিশ্বাস। ‘বন্দে মাতারাম’ ও ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনিতে মুখরিত হলো কুইন স্ট্রিট। জনতার আশীর্বাদ নিয়ে পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়লেন ৩৫ বছর বয়সী যুবক রামনাথ বিশ্বাস।
রামনাথের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি আসমের সিলেট জেলার বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায় যা বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার অর্ন্তভুক্ত। বাবা বিরজানাথ বিশ্বাস আর মা গুণময়ী দেবীর দুই সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বড় ভাই কৃপানাথ বিশ্বাস এলাকার নামকরা চিকিৎসক ছিলেন। শৈশবেই মা-বাবাকে হারান তিনি। এরপর বড় ভাইয়ের সংসারেই বেড়ে ওঠেন রামনাথ। ভর্তি হন বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন বিদ্যালয় ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন। বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য হন। বেশ কয়েক বছর অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দেন বাঙালি পল্টনে। তবে অসুস্থতার কারণে বাঙালি পল্টনে বেশি দিন কাজ করা হয়নি তার। কিছুদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর ১৯১৮ সালে আবারও যোগ দেন সৈন্য বাহিনী। চাকরির সুবাদে ঘুরে বেড়ান বেশ কিছু জায়গা। এখান থেকেই তিনি পেয়ে যান ভ্রমণের অনুপ্রেরণা। সেই অনুপ্রেরণাই তাকে সাইকেলসমেত পৃথিবীর পথে নামিয়েছিল। সবমিলিয়ে নয় বছরের মতো ভ্রমণ করেছেন তিনি। পাড়ি দিয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষ কিলোমিটার পথ। দেখেছেন চল্লিশটির অধিক দেশ।
শুরু করেছেলিন সিঙ্গাপুর থেকে। তিনি তখন চাকরির সুবাধে সিঙ্গাপুরে থাকেন। প্রথমে যান মালয়েশিয়া। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে চীনে। চীন রামানাথের কাছে খুব প্রিয় একটি দেশ ছিল। ফলে দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন এই দেশে। এরপর কোরিয়া হয়ে জাপানে যখন পা রাখে ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন দিনটি ১৯৩২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। অতিবাহিত হয়েছে একটি বছর। সেখান থেকে পাড়ি জমান ফিলিপাইন। ঘুরে দেখেন ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ। এরপর ফের ফিরে আসেন সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরে মাস দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর পথে। সিঙ্গাপুর থেকে রেলগাড়িতে করে পেনাং (মালয়েশিয়া)। সেখান থেকে জাহাজে মিয়ানমার। ছয় মাস মিয়ানমার ঘুরে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর, শিলং ঘুরে জন্মভূমি সিলেট ফেরেন। সিলেটে এসে এক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পান। একটু সুস্থ হয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, রাজশাহী, মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে কলকাতায় যান। মাস ছয়েক কলকাতায় কাটান। ১৯৩৪ সালের জুলাইয়ে আবার বের হন।
এবার গন্তব্য উত্তর ভারত। সমগ্র উত্তর ভারত ভ্রমণ শেষে আফগানিস্তান পৌছান। সেখান থেকে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ভ্রমণ শেষে লেবানন হয়ে তুরস্ক যান। তুরস্ক থেকে ইউরোপের বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ইংল্যান্ড স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ভ্রমণ শেষে জাহাজে করে আবার কলকাতা ফেরেন। কলকাতায় ফিরে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লেখা আকারে প্রকাশের চেষ্টা করেন। প্রবর্তক পত্রিকায় সর্বপ্রথম তার লেখা প্রকাশিত হয়। এরপর আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, দেশ, বসুমতী, সঞ্জীবনী প্রভৃতিতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৯৩৭ সালে যখন রামনাথ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ নিতে শান্তি নিকেতনে যান। কবিগুরু তাকে আশীর্বাদ করেন এবং জানান তিনি তার লেখা পড়েন। কবিগুরুর আশীর্বাদ নিয়েই ১৯৩৮ সালে রামানাথ ফের বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। এটাই ছিল রামনাথের শেষ বিশ্বভ্রমণ। এবার গন্তব্য আফ্রিকা। প্রথমে কলকাতা থেকে মুম্বাই যান। এরপর জাহাজে করে মোম্বাসোয় (কেনিয়া) পৌছান।
এরপর কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, জানজিবার, মালাউই, মোজাম্বিক, জিম্বাবুয়ে হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যান। আফ্রিকা ভ্রমণের পালা সাঙ্গ করে রামানাথ জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রে যান। যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিন বন্দী ছিলেন তিনি। এরপর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমতি নিয়ে সমগ্র দেশ ভ্রমণ করেন। তার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময়ই দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হয়। জাহাজে করে দেশে ফিরে আসেন রামানাথ বিশ্বাস। দেশে ফিরে তাঁর দীর্ঘ সাইকেল ভ্রমণে দেখা দেশ, মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতির কথা বই আকারে প্রকাশ শুরু করেন। ভ্রমণকাহিনি, গল্প –উপন্যাস মিলিয়ে রামনাথ বিশ্বাসের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪০। রামানাথ বিশ্বাসের শেষ জীবন কলকাতেই কেটেছে। ১৯৫৫ সালের ১৯ নভেম্বর সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্বজয়ী বাঙালী ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো, বিভিন্ন ব্লগ