রাতে একা ভ্রমণে ভয়টা ছিল বেশি (নোরালির বিশ্বভ্রমণ,পর্ব-২)

শোয়ায়েব চমক

যারা গত পর্ব পড়েছেন, তাদের অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে নোরালি তার বিশ্বভ্রমণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে কেন আসেনি? সেতো বাংলাদেশের আশপাশ দিয়েই ঘুরেছে। বিশেষ করে সে যখন শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, তুরা, শিলং, চেরাপুঞ্জি ঘুরেছে, সে সময় তো এক ফাঁকে বাংলাদেশেও আসতে পারত। তবে কি নোরালি বাংলাদেশ পছন্দ করে না?

আপনাদের চিন্তা দূর করে দিচ্ছি। নোরালি বাংলাদেশে এসেছিল। ২০১৮ এর সেপ্টেম্বর/অক্টোবরে যখন নোরালি তার ভাড়া করা রয়াল এনফিল্ড মোটরসাইকেল নিয়ে জম্মু-কাশ্মির ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন সে কাশ্মিরে এক বিয়ের দাওয়াত পায়। দাওয়াতটা এমনভাবে করা হয় যে সে আর না করতে পারে না। ইতিমধ্যে নোরালি হিমাচল, জম্মু-কাশ্মির, লাদাখ, কারগিল ভ্রমণ শেষ করে আবার দিল্লি ফেরত চলে এসেছে। এখন কয়েক সপ্তাহ পর তাকে আবার কাশ্মিও যেতে হবে বিয়ের অনুষ্ঠানে। মাঝখানের এই বিরতিতে দিল্লি বসে না থেকে নোরালি চিন্তা করল আশেপাশের আর কোন দেশ বেড়ানো যায় কিনা? সে বসে গেল ম্যাপ নিয়ে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে একা একা সে পাকিস্তান বা আফগানিস্থান যেতে চাইল না। নেপাল এবং ভুটান সে আগে ঘুরেছে। বাংলাদেশ ভ্রমণটাই তার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। কারন আগে কখনো সে বাংলাদেশে আসেনি।

সমস্যা হল নোরালি তার ভাড়া করা মোটরসাইকেল ফেরত দিয়ে মাত্রই নতুন একটা রয়াল এনফিল্ড হিমালয়ান কিনেছে। তার ভারতীয় বন্ধু মোটর সাইকেলটির কাগজপত্র রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়ায় সাহায্য করছে। তাই এই মুহুর্তে সাধারণ যানবাহন ব্যবহার করে বাংলাদেশ ভ্রমণ করা ছাড়া নোরালির আর কোন উপায় নেই। শিলং থেকে সিলেট দিয়ে নোরালি বাংলাদেশ চলে এল। সিলেটের জাফলং, বিছানাকান্দি ইত্যাদি ঘুরে সে চলল ঢাকার দিকে। নিজস্ব বাহন সঙ্গে না থাকায় নোরালি ট্রেনে করে সিলেট থেকে ঢাকার দিকে রওনা হয়। তার পরিকল্পনা বান্দরবান যাওয়া। যেহেতু রাতের ট্রেন, সে চাইছিল প্রথম শ্রেনীর টিকেট কাটতে। কিন্তু কোন টিকেট পাওয়া গেল না। স্থানীয় রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় দ্বিতীয় শ্রেনীর টিকেট যোগাড় হল। পুলিশ ভিড় ঠেলে নোরালিকে ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেনীর কামরায় একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল।

পাহাড়পুর

ট্রেন ছাড়ার পর নোরালি বেশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে লাগল। কারণ, একে তো বাংলাদেশে সে কখনো আসেনি, এদেশের সংস্কৃতি তার কাছে একেবারেই অজানা। দ্বিতীয়ত রাতের ট্রেন, রাতে ভ্রমণ নোরালির একেবারেই অপছন্দ। তার উপর সে একা সোনালি চুলের একমাত্র বিদেশি একটা মেয়ে ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেনীর বগিতে একগাদা অপরিচিত মানুষের সাথে বসে আছে যারা কিনা এক পলকের জন্যও তার উপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না। কেউ কেউ আবার চিৎকার করে প্রশ্ন করছে “Hello”, “How are you”, “are you married”, “which country”। এর মধ্যে এক হিজড়া নোরালির কাছ থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বেশ কিছু টাকাপয়সা নিয়ে গেল। আশেপাশের কেউ তাকে সাহায্য করল না বরং সেই হিজড়ার কান্ড দেখে সবাই দেখা গেল বেশ মজাই পেল। স্বভাবতই নোরালি সারারাত ঘুমাতে পারেনি। তার মতে সেটা ছিল জীবনের অন্যতম ভীতিকর রাত।

সকালবেলা ঢাকা পৌঁছে নোরালি তার বুকিং করা হোটেলে গিয়ে উঠল। কোনমতে সকালের নাস্তা করে, ভালমত গোসল করে, ট্রেনে সারারাতের ভীতিকর অভিজ্ঞতা আর না ঘুমিয়ে রাত কাটানোর ক্লান্তিতে সে দিল এক লম্বা ঘুম। বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে আসেপাশে একটু ঘুরে সন্ধ্যার আগেই আবার হোটেলে ফিরে এল। পরদিন ট্রেনের ঝামেলায় না গিয়ে হোটেলের সাহায্য নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেলল। গাড়ি তাকে নিয়ে যাবে চট্টগ্রাম। তবে সে ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দিলো মাঝপথে কোথায় কোথায় সে থামতে চায়। সেভাবে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম পার হয়ে সে আবার শুরু করল তার বাংলাদেশ ভ্রমণ। প্রথমে সে গেল সোনারগাঁও, সেখান থেকে গেল ময়নামতি। এখানে সে অনেকটা সময় থাকল। সে আর তার ড্রাইভার দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা চলে এল চট্টগ্রাম। নির্ধারিত হোটেলে ড্রাইভার তাকে নামিয়ে দিল। দুদিন চট্টগ্রাম থেকে সে চলে গেল কক্সবাজার। সেখানে একদিন থেকে সে গেল বান্দরবান।

বান্দরবানে বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে সে খুব আনন্দের সাথে সময় কাটিয়েছে। তারা যদিও ইংরেজি বলতে পারে না কিন্তু সবাই হাসিমুখে নোরালির সাথে ভাল ব্যবহার করেছে। ইংরেজি না জানলেও আকারে ইঙ্গিতে তার সঙ্গে কথা বার্তা চালিয়েছে। তারা নোরালিকে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এক উপজাতি থেকে তাকে নিয়ে গেছে আর এক উপজাতীর কাছে। সেখানে নোরালি সপ্তাখানেক ছিল। সে অবাক হয়েছে দেখে যে এই সব উপজাতি, তাদের সবার আলাদা ভাষা আছে, আলাদা ধর্ম আছে, আলাদা শারীরিক গঠন এবং রীতিনীতি আছে। কিন্তু সব উপজাতি বান্দরবানে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকছে। নোরালিকে সবাই সবার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। কোন হিংসা, ঘৃণা বা উপজাতিদের মধ্যে রেষারেষি নোরালির চোখে পড়েনি।

সুন্দরবন

বান্দরবানে থাকাকালীন সময়ে তার সঙ্গে কথা হয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তাদেও সঙ্গেও। নোরালির ভ্রমণের গল্প শুনে আর তার আগামী দীর্ঘ মেয়াদী বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা শুনে সেখানকার কয়েকজন অফিসার নোরালিকে সুন্দরবন ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেন। নোরালি বান্দরবান থেকে চলে আসে কুয়াকাটা, সেখান থেকে সুন্দরবন। কুয়াকাটা, সুন্দরবন মিলে সপ্তাখানেক নোরালি বেশ ভালই সময় কাটালো। সেখান থেকে বেনাপোল দিয়ে কলকাতা হয়ে নোরালি আবার দিল্লি ফেরত চলে গেল।


বাংলাদেশ সম্পর্কে তার সারমর্ম হচ্ছে, এদেশের মানুষ খুবই কৌতুহলী। রাস্তায় অহরহ বিদেশি দেখে না বলে হয়তো তাদের কৌতূহল বেশি। বিদেশিদের ব্যাপারে ভারতের মানুষের কৌতুহল কম কারণ সেখানে প্রায় সব এলাকায় অনেক বিদেশিদের বছরের নানা সময় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। কারণ প্রতি বছর প্রচুর বিদেশি বিভিন্ন সময় ভারত ভ্রমণ করে। বাংলাদেশে হয়তো অতটা করে না। তবে বাংলাদেশ অনেক সুন্দর। বিদেশি পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক কিছুই আছে যা হয়তো বিদেশি পর্যটকরা জানে না বলেই আসে না

বাংলাদেশ ভ্রমণে আর একটা জিনিস নোরালির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ভাষা যাই হোক না কেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে তাকে সক্ষম হতে হবে। সাহসী হতে হবে। নিজে থেকেই এগিয়ে আসতে হবে যোগাযোগ স্থাপনে। একটা দেশ, তাদের সংস্কৃতি এবং রীতিনীতি বুঝতে হলে তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। সেটা ভাষার মাধ্যমেই হোক বা শারীরিক আকার ইঙ্গিতে হোক। এইজন্য পরবর্তীতে নোরালি তার বিশ্বভ্রমণে যতটুকু সম্ভব গুগল ট্রান্সলেটর বা অন্য সব অ্যাপস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেছে। বরং ছোট ছোট ইংরেজি আর হাতে পায়ের আকার ইঙ্গিতে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন