যেখানে দেখা মেলে পুরোনো দিনের

ঈমন খান

মাঝে মাঝে আপনি নিশ্চয়ই হারিয়ে যেতে চান? তবে তা দূরে কোথাও নয়, মহাকালের গর্ভে! মনে হবে যদি ফিরে যেতে পারতেন শতাব্দী পুরনো কোন জগতে! কিন্তু শতাব্দী পুরনো জগতে ফেরার অনুভূতি পেতে যেতে হবে নভোযানে করে মোক্ষম জায়গাতে! মজার বিষয় হচ্ছে, আমার তা করতে হয়নি। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় আমি এমন একটি জায়গার খোঁজ পেয়েছি। এখানকার চাঁদপুর ইউনিয়নের ঘাটকুঁড়ি হাট আপনাকে নিয়ে যাবে শতাব্দী পেছনে। এখনো মাটির ঘরে বাজার বসে। পুরোনো কায়দায় চলে কেনাবেচা। এও কি সম্ভব ডিজিটাল যুগে?

ঘাটকুঁড়ি হাট

যাচাই করতে বের হলাম। আমার টাইম-ট্রাভেলিং-এ সঙ্গী থাকা চাই। তা না হলে আটকে যেতে পারি অতীতে! একেবারে হুট করেই বন্ধু সায়েকাকে সঙ্গে নিয়ে শুক্রবার রওনা হলাম গাজীপুরের উদ্দেশ্যে।  ধুলো-মিশ্রিত-জ্যামে-ঠাসা কিন্তু কেন যেন মিষ্টি এই ভ্রমণ শেষ হয় কোট কাপাসিয়াতে গিয়ে! কিন্তু বিধি ত বাম। যেখানে যাব-সেখান থেকে আরও ২০ কিলোমিটার সামনে চলে এসেছি! আরেক বাসে কওে ফের ফিরলাম কাপাসিয়াতে, গন্তব্য চাঁদপুর ইউনিয়ন। পঙ্খীরাজের মত অটো নিয়ে রওনা হলাম কাপাসিয়া বাজার থেকে চাঁদপুর ইউনিয়নে। বেলা তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। মনের ভেতর একটা অজানা ভয় উঁকি দিল। আজ কি তাহলে ট্রাইম ট্রাভেলিং হচ্ছে না? পথিমধ্যের কাপাসিয়া এলাকার মাটির ঘর দেখে আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম- দুধের সাধ ঘোলে কিছুটা হলেও মেটানো দরকার। সামনে কি আছে ঈশ্বর জানেন! চাঁদপুর বাজারে পৌঁছে কিছুদূর গিয়ে যখন ঘাটকুঁড়ি হাটে পৌঁছলাম, তখন শুরু হল টাইম-ট্রাভেলিং এর আসল খেলা!  হাটে পৌঁছানোর পর আমাদের দুজনের অনুভূতি ছিল ছোটবেলায় প্রথম সাগর দেখে যেমন একটা মহাজাগতিক সৌন্দর্য দেখার অনুভূতি হয়েছিল- ঠিক তেমন! একেবারে কবিতার বইয়ের মত সারি-সারি মাটির ঘরের ভেতর গ্রামের মানুষ বাজার বসিয়েছে। নরসুন্দর খোলা আকাশের নিচে তার কাজ করে যাচ্ছে। আর সাথে আরো হরেক রকম চিত্র! এখনো যে দেশে এভাবে মাটির ঘরেই বাজার বসবার মত জায়গা টিকে আছে- তা নিজ চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস হত না! হাঁটের বাতাস, মাটির গন্ধ, মানুষের চলাফেরা- সবকিছুই আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল দূর কোন অতীতে-যা দেখার সৌভাগ্য কখনও হয়নি আগে!

Caption

অবাক হবার ধাক্কা কাটিয়ে ছবি তোলবার চেষ্টা করলাম। আবিষ্কার করলাম হাঁটের পাশেই মৃতপ্রায় একটি খাল বয়ে যাচ্ছে! ব্যাপারিদের কাছে জানলাম, এক সময় এই খালে শতশত নৌকা আসত- হাটের মালামাল নিয়ে! কিন্তু বছর দশেক আগে কোন একটি ব্রিজ নির্মাণের পর সব শেষ। কোন নৌকা তো ঢুকতেই পারে না- আর সবকিছুই এখন অতীত- যা একই সাথে কেড়ে নিয়েছে হাঁটের জৌলুসকেও! ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বৈকি আর কিছু করার ছিল না, ততক্ষণে সায়েকা নিজেকে হাঁটের একজন হিসেবে মানিয়ে নিয়েছে। হাঁটের মানুষ বেশ বন্ধুসুলভ, সায়কাকে টাটকা একটি গাজর দিয়ে সেটার দাম রাখে নি- আর সে সেটা নিয়ে ছিল দারুন উচ্ছ্বাসিত

বেলাশেষে তুখোড় সব গাছের নির্ভেজাল বীজ কিনে সায়েক যখন কিছুটা খুশি, তখন ভেবে দেখলাম, উনিশ শতক থেকে এবার বর্তমানে আবার ফিরে যাবার সময় হয়েছে। তবে হাঁটের মোহ এতটাই তীব্র ছিল- সিএনজিতে করে ফেরার সময় সায়েকা কি অতীতেই ছিল কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে থাকবে! ঠিক কতদিন হাটকুঁড়ি হাঁটের এ স্মৃতি মাথায় নিয়ে ঘুরব তা জানি না, তবে হাট থেকে ফিরে আসার পর অতীতকে আর বেশি অনুভব করতে শুরু করলাম!

যেভাবে যাবেন: আপনিও যদি আমাদের মত অতীতে ফিরে যাবার অনুভূতি চান- তাহলে সোজা মহাখালী বাস কাউন্টারে চলে যাবেন। হাট বসে শুক্রবার এবং সপ্তাহের আরেকটি দিন, শুক্রবার বেছে নেয়াটাই উত্তম। অনন্যা ক্লাসিক বা এই লাইনের অন্য কোন বাসে করে কাপাসিয়া বাজারে গিয়ে নামবেন। কাপাসিয়া বাজার থেকে অটো বাইক ভাড়া করে চাঁদপুর ইউনিয়ন হয়ে চলে যাবেন ঘাটকুঁড়ি হাটে। যেহেতু একেবারেই নতুন এলাকা, তাই সন্ধ্যার ভেতর ফিরে আসাটাই ভাল, থাকার তেমন ব্যবস্থা ঐ এলাকায় চোখে পরেনি। খরচ: মহাখালী থেকে কাপাসিয়া যেতে ১৫০ টাকা করে নিবে মাথা পিছু অনন্যা ক্ল্যাসিকে। কাপাসিয়া থেকে অটো রিজার্ভ নিলে ঘাটকুঁড়ি হাট অবধি ১৫০ টাকা। একটা কথা মনে রাখা খুব জরুরি, ঘুরতে গিয়ে অবশ্যই নোংরা আবর্জনা, প্লাস্টিক ফেলে পরিবেশ দূষিত করবেন না। যথাস্থানে উচ্ছিষ্ঠ ফেলে সুন্দর এই মাটির ঘরের এলাকাটি নিষ্কলঙ্ক রাখুন। পুনশ্চ: টাইম-ট্রাভেলিং-এর স্বাদ সবাইকে দিতে একটি  সাদা-কালো ছবি দিলাম।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন