মোগল ঐতিহ্যে তৈরি তাজহাট জমিদার বাড়ি

রাহিবুল ইসলাম রাকিব

অবসরে বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দময় সময় কাটানোর জন্যই নিরিবিলি ও সাজানো-গোছানো জায়গা সবারই পছন্দ। রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি এরকমই একটি জায়গা। নিছক একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এটিকে ভাবলে ভুল হবে কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য। বর্তমানে এটি রংপুর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রংপুরের প্রত্নতাত্ত্বিক গর্ব তাজহাট জমিদার বাড়ির অবস্থান রংপুর জেলা সদর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে তাজহাট গ্রামে।  রত্ন ব্যবসায়ী মান্না লাল রায়পাঞ্জাবের অধিবাসী ছিলেন। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে শিখদের সংঘাতের সময় তিনি পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে রংপুরের মাহিগঞ্জে বসতি স্থাপন করেন। এখানে তিনি হীরা, মনি ও মুক্তাখচিত টুপি (তাজ) ব্যবসার প্রচলন করেন। সেই থেকে এই স্থানের নাম তাজহাট। মান্না লাল রায় তাজহাট জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা।

বর্তমানে এটি রংপুর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মান্না লাল রায় মারা যাবার পর তার সন্তান গিরিধারী লাল জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন। গিরিধারী লাল ছিলেন নিঃ সন্তান। তিনি মারা যাবার পর তার পালক পুত্র গোবিন্দলাল জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন। গোবিন্দলালের পুত্র গোপাল লাল রায় ১৯০৮ সালে এই প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। দুই হাজার শ্রমিকের দশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯১৭ সালে প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কথিত আছে প্রাসাদ নির্মাণে তৎকালীন সময়ের দেড়কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। তবে প্রাসাদে খুব বেশিদিন বসবাস করতে পারেননি জমিদার। ১৯৫৫ সালে তিনি মারা যান। এরপর প্রাসাদটি দীর্ঘকাল পরিত্যাক্ত ছিল।

তাজহাট জমিদার বাড়ী

১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাসাদটি ব্যবহৃত হয় রংপুর হাইকোর্ট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একটি শাখা বা বেঞ্চ হিসেবে। এরপর ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রাসাদটিকে একটি সংরক্ষিত স্থাপনা তথা স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করে। সরকার এ স্থাপত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০০৫ সালে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি থেকে জাদুঘরকে সরিয়ে এ প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসে। প্রথম দেখায় প্রাসাদটিকে দেখলে যে কেউ একে ঢাকার আহসান মঞ্জিল ভেবে ভুল করবেন। কারণ প্রাসাদটির সম্মুখ অংশ অবিকল ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মতো। তবে প্রাসাদটি তার সম্মুখভাগের সিঁড়ির কারণে বাংলাদেশের অন্য সকল জমিদার বাড়ি থেকে আলাদা। সর্বমোট ৩১টি সিঁড়ি আছে যার প্রতিটিই ইতালীয় ঘরানার মার্বেল পাথরে তৈরি। সিঁড়ি থেকে উঠে জাদুঘর পর্যন্ত মেঝের পুরোটাও একই পাথরে তৈরি।

মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরে উঠলেই রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ যাতে রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে সংস্কৃত এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশকিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি। এর মধ্যে রয়েছে মোগল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের সময়ের কুরআন, মহাভারত, রামায়ণ। পেছনের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটা কাল পাথরের হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি। প্রাসাদটি প্রায় ২১০ ফুটের মত প্রশস্ত ও চার তলার সমান উঁচু। এর গঠনশৈলী প্রাচীন মোগল স্থাপত্যশৈলি থেকে অনুপ্রাণিত বলে মনে করা হয়। প্রাসাদের ছাদের মধ্যভাগে বিশাল একটি গম্বুজ রয়েছে। কথিত আছে এই গম্বুজে উঠে জমিদার গোপাল রায় গরমের দিনে হাওয়া খেতেন। এইজন্য এটাকে হাওয়াখানাও বলা হয়। তবে কারো কারো মতো এটি হাওয়াখানা নয়। এখান থেকে জমিদারের পেয়াদারা চারপাশে নজরদারি করত।

হাওয়াখানা 

প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে বিশাল খালি মাঠ, নজরকাড়া ফুলের বাগান, মেহগনি, কাঠাল ও আমগাছের গাছের সারি। প্রাসাদের দুপাশে রয়েছে দুইটি পুকুর। প্রাসাদচত্ত্বরে সুন্দর ফোয়ারাটি কালের বিবর্তনে শ্বেতশুভ্র মার্বেল ও তার সবুজাভ নকশা কিছুটা মলিন হলেও এখনো এর জৌলুষ বুঝা যায়। কথিত আছে রাণীর জন্যেই বিশেষ করে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সবমিলিয়ে তাজহাট জমিদার বাড়ির যেদিকে চোখ যায় সেদিকে যেন স্থাপত্য এবং শিল্প হাত ধরাধরি করে আছে।

যেভাবে যাবেন দেশের যেকোন স্থান থেকে রংপুরে পৌঁছে রংপুর বাস টার্মিনালে নামবেন। বাস টার্মিনাল থেকে জাদুঘরের গেট পর্যন্ত রিকশা ভাড়া ২০ টাকা। তবে রিকশায় ওঠার সময় ভাড়া ঠিক করে নেয়াই শ্রেয়।

 

সময়সূচি: গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এসময় দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর শীতকালে (অক্টোম্বর-মার্চ) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এসময় দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রোববার সাধারণ ছুটি এবং সোমবার বেলা ২.০০ থেকে খোলা থাকে। এছাড়াও সরকারি বিশেষ দিবসে জাদুঘর বন্ধ থাকে।

টিকেট: জাদুঘরের গেটের পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য জনপ্রতি টিকেট এর দাম বিশ টাকা করে। পাঁচ বছরের কমবয়সী কোন শিশুর জন্যে টিকেট কাটার দরকার হয় না। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ টাকা। বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য দুই ধরনের টিকেট। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। অন্যান্য বিদেশি নাগরিকদের জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন