মাহামুদ হাসান প্রিন্স
১৮৫৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। ফাঁসির রজ্জু থেকে ‘মণিরাম দেওয়ান’ এর নিথর দেহটা নামানো হলো। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারীর পরিচয়টা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ‘আসাম চা’ আবিস্কারের অন্যতম পথদ্রষ্টা তিনি। চা চাষে সফল প্রথম উদ্যোক্তা। ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুস যখন আসাম জুড়ে চা গাছের ব্যাপক অনুসন্ধান চালান, মণিরামই সর্বপ্রথম তাঁকে সেই সন্ধান দেন। রবার্ট ব্রুসের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই চার্লস আলেকাজান্ডার ব্রুস ১৮২৫ সালে মণিরামের সহায়তায় সিংফো উপজাতিদের দলপতির কাছ থেকে আসাম জাতের চায়ের বীজ সংগ্রহ করেন।
চা আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮২৮ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সী মণিরামকে রংপুর এলাকার তহশিলদার ও সেরেস্তাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়। অতঃপর ১৮৩৩ সালে আসামের তৎকালীন রাজা পুরন্দার সিং এর ‘হেড অব রয়েল ট্রেজারি’ তথা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ১৮৩৯ সালে কোম্পানি মণিরামকে মাসিক ২০০ রুপি বেতনে ‘আসাম টি কোম্পানি’র ‘দেওয়ান’ (প্রধান নির্বাহী) হিসেবে নিযুক্ত করে। কোম্পানীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতদ্বৈততা হওয়ায় কয়েক বছরের মাঝেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইত্যবসরে চা চাষ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি তিনি দুটি চা বাগান প্রস্তুত করেন। একটি জোড়হাটের সিন্নামারায় (বর্তমানে ‘সিন্নামারা টি এস্টেট’ নামে পরিচিত)। আর অন্যটি শিবসাগরের সিংলোতে। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেন আসামের প্রথম ভারতীয় টি-প্ল্যান্টার। চা শিল্প ছাড়াও মণিরাম স্বর্ণ কেনাকাটা, সিরামিক, কয়লা সরবরাহ এবং লবণ উৎপাদনের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি নিড়ানি ও ছুঁরি-কাঁচির ব্যবসা এবং কৃষি পণ্যের ব্যবসাসহ আরও বহুবিধ ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
১৮৫৩ থেকে ১৮৫৭ সালের মাঝে তাঁর চায়ের আবাদি এলাকা ৬০০ বিঘা থেকে ১৯৪১ বিঘায় উন্নীত হয়। ১৮৫৭ সালে তাঁর বাগানে উৎপাদিত হয় ৪৫০০০ পাউন্ড চা। সে সময়ের হিসেবে যা ছিল রীতিমত অবিশ্বাস্য ব্যাপার! তবে ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই ব্যবসায়িক সফলতা এতটা সহজ ছিল না। ব্রিটিশদের বিপরীতে আদালতে বেশ কয়েকবার আইনি লড়াইতে তাঁকে সামিল হতে হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছিল মণিরামের শিক্ষা, পারিবারিক ঐতিহ্য, ক্ষুরধার চিন্তাশক্তি ও অসাধারণ কর্মদক্ষতার জন্য। মণিরাম দেওয়ানের পুরো নাম মণিরাম দত্ত বড়ুয়া। জন্ম ১৮০৬ সালের ১৭ এপ্রিল। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কনৌজের অধিবাসী। ষোল শতকের শুরুর দিকে তাঁরা আসামে স্থায়ী হন। মণিরামের দাদা-পরদাদারা অহম আদালত (অহম রাজবংশ) এর উচ্চপদে আসীন ছিলেন। বার্মার আসাম আক্রমণের সময় (১৮১৭-১৮২৬) মণিরামের পরিবার আসামে আশ্রয় গ্রহণ করে। অসমিয়া শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে বাংলা চর্চার সূত্রপাত ঘটে মণিরাম দেওয়ানসহ হলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন, যজ্ঞরাম খারঘরিয়া ফুকন, জাদুরাম ভেকা বড়ুয়া প্রমুখ অসমিয়াভাষী বিদ্বৎজনের মাধ্যমে। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি আসাম থেকে কোনো সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়নি। এমনকি ১৮৩৬ এর পূর্বে সেখানে ছাপাখানা বা মুদ্রণযন্ত্রও গড়ে ওঠেনি। মণিরাম দেওয়ানসহ অন্যান্য বিদ্বৎজনরা সমাচার দর্পন, সমাচার চন্দ্রিকা, বঙ্গদূতসহ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লেখা পাঠিয়ে আসামবাসীর মাঝে গদ্য চর্চার ধারাটা চালু রেখেছিলেন। হতদরিদ্র আসামবাসীদের হয়ে মণিরাম ব্রিটিশ শোষণ নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন বারংবার। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন তখন ক্রমশ ছড়াচ্ছে। সে আঁচ পড়েছিল আসামেও। আন্দোলন সংগঠিত করতে এগিয়ে আসেন মণিরাম। আসাম রাজার উত্তরসূরি কন্দর্পেশ্বর সিংহকে এক গোপন সাংকেতিক চিঠির মাধ্যমে আসামের রাজ্যভার পুনরায় দখল করার পরিকল্পনা দেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মণিরামকে গ্রেফতার করা হয়। আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনরকম সুযোগ না দিয়েই ১৮৫৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জোড়হাট কারাগারে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
ইংরেজদের হাতে নতুন করে লেখা হয় আসামের চায়ের ইতিহাস। সমসাময়িক সমস্ত পুস্তকাদি ও দলিল-দস্তাবেজ হতে নিশ্চিহ্ন করা হয় মণিরামের অবদান। তবে ব্রিটিশ লেখক Samuel Baildon (১৮৭৭) এর লেখা ‘ Tea in Assam’ এবং পরবর্তীতে Stanly Boldwin এর লেখা ‘Assam’s Tea ’ গ্রন্থে মণিরামের স্বীকৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে কয়েকজন ভারতীয় লেখকের বইতে নতুন করে লেখা হয় এই বীরের জীবনগাঁথা। মণিরাম চা’কে আসামের অহঙ্কার মনে করতেন। ১৯১১ সালে তাঁর স্মৃতিময় সিন্নামারা চা বাগানে স্থাপিত হয়েছে পৃথিবীর প্রথম চা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘টোকলাই’। ১৯৬৩ সালে মণিরাম দেওয়ানকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ভারতে। ছবিটি ‘রাষ্ট্রপতি রৌপ্য পদক’ পায়। স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার কন্ঠে, ‘মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই/জল থৈ থৈ করে কিছু নেই নেই/ভাঙনের যে নেই পারাপার/তুমি আমি সব একাকার।....পুরনো সব নিয়ম ভাঙে অনিয়মের ঝড়/ঝড়ো হাওয়া ভেঙ্গে দিও মিথ্যে তাসের ঘর/নুতন মাটিতে আসে ফসলেরই কাল/আধার পেরিয়ে আসে আগামী সকাল.. ’ গানটি অসমীয়া ভাষায় গাওয়া হয় ছবিতে। যা সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
মণিরামকে নিয়ে লেখা লোকসঙ্গীত ‘মণিরাম দেওয়ানের গীত’ আসামে বহুল প্রচলিত। ভারতের গৌহাটিতে ‘মণিরাম ট্রেড সেন্টার’ এবং ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র হোস্টেল রয়েছে তাঁর নামে। সিন্নামারা চা বাগানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীর। আসামবাসীর জন্য প্রাণ দিলেন মণিরাম। ভারতকে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সহায়তা করলেন। অথচ সেই মণিরামের উত্তরসূরীদের আজ এনআরসি ষড়যন্ত্রে দেশ-পরিচয়হীন অস্পৃশ্য হিসেবে আত্মহুতি দিতে হচ্ছে! পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে! ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুমুখে পতিত হতে হচ্ছে!