মিয়ানমারের পথে পথে (পর্ব-১)

কাফি কামাল

সাধ্যহীন সাধ নিয়ে আমি এক মগ্ন ভ্রামণিক। জন্মভূমি বাংলাদেশের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে কয়েকটি দেশে। তারই একটি হচ্ছে- বৈরী প্রতিবেশী বার্মা। আমি উপভোগ করতে চেয়েছি দেশটির প্রকৃতি, স্থাপত্যকলা আর মনুষ্যস্বভাব। নেইপিডোর সেলসগার্লের জবান, বাগানের প্যাগোড়া সংক্রান্ত মিথ, মেহিকান তরুনীদের কলকাকলী, মাইনকাবা গ্রামের শ্রমজীবী পরিবার, পিন উ লউইনের লীলাময় নিসর্গ, জুন মসজিদে বুড়ো ডাক্তারের নিরব চাহনি, মান্দালয় হিলের চুঁড়া থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতির কারাগার, মুখে তানাক্কার নক্শা আঁকা মেয়ে, রেঙ্গুন ফেরিঘাটে বৃষ্টি, সন্ধ্যাকালীন জমজমাট স্ট্রিট ফুডের দোকান, শোয়েডাগনে তরুণ চিত্রশিল্পীর দল, বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিস্থলের নির্জনতা, সার্কুলার ট্রেনে কথাব্যস্ত রমনী ও যুবকদের পায়ে সিনলুনশৈলী,  চলতি পথের খুঁটিনাটি- সবকিছু আমার কাছে সমান রঙিন। নানা আকর্ষণীয় স্থান ঘুরে দেখতে দেখতে বন্ধুদেরও অবলীলায় করে নিতে চাই ছায়াসঙ্গী। আসুন তাহলে, শুরু করি।

 

বৃষ্টি ও বিরিয়ানী

Welcome to Myanmar, the dragon land. ভয় ও কৌতূহল মেশানো একধরনের অনুভূতি নিয়ে পা রাখলাম রেঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি, ফলে বার্মিজ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার বিশেষ মনোযোগ পেতে পারি। অনাকাঙ্ক্ষিত জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও পড়তে পারি। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। কিউতে দাঁড়ালে অন্যান্য বিদেশীর মতো পাসপোর্ট দেখে আমার ফরমটিও পূর্ণ করেদিল এক তরুণী। মাত্র তিনটি প্রশ্নের পর সিল মেরে পাসপোর্ট এগিয়ে দিলেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা । চেকিং পয়েন্টে পেরিয়ে মূদ্রা পরিবর্তন করলাম। বাংলাদেশের একটাকা সমান যখন বার্মার ১৪ কিয়েট তখন মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গেলাম লাখোপতি। বিমানবন্দরটির দুইটি অংশ। পুরোনো অংশটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর। সে ভবনের তৃতীয় তলায় নভোএয়ারের অফিস। সে অফিসের সামনের বেলকনি থেকে পুরোনো ভবনের নিচের পুরো অংশটি নজরে আসে। নভোএয়ারের অফিসে মোর্শেদ ভাই স্বাগত জানালেন। দেশে থাকতেই ফোনে কথা হয়েছিল। বললেন, আজকের মতো কার্যক্রম শেষ, কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার সাথে বেরিয়ে পড়বেন।

বিমানবন্দরটির দুইটি অংশ, পুরোনো অংশটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর

রেঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শহরমুখী এগোলে রাস্তায় প্রথম যে ত্রিমোহনাটি সামনে পড়বে ঠিক সেখানেই আপনাকে স্বাগত জানাবে পাথুরে ফলকে লেখা এ স্বাগত সম্ভাষণলিপি। ত্রিমোহনা থেকে বামে মোড় নিয়ে সোজা রেঙ্গুন শহরে চলে গেছে পেয়ি রোড। ট্যাক্সির গতিমুখ ছিল সেদিকে। নভোএয়ারের মায়ানমার প্রতিনিধি মোরশেদ হালকা ধমকের স্বরে চালক আবদুল মাবুদকে বললেন, ‘টার্মিনাল যাবো তো ভাই, ডানে ঘুরেন’। মাবুদ ত্বরিৎ স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ডানে মোড় নিলেন। পেয়ি রোড ধরে ডানে সামনে এগোতেই ফের যে ত্রিমোহনাটি চোখে পড়ল তার হৃদয়জুড়ে নান্ট থার মায়িং পাবলিক পার্ক। সে পার্ক থেকে বামে ইনসেইনের দিকে চলে গেছে লানথিট রোড আর ডানে বিমানবন্দরের পশ্চিম সীমানা ঘেষে সিটি গলফ কোর্সের পূর্বপ্রান্ত ধরে উত্তরমুখী চলে গেছে রেঙ্গুন-মান্দালয় হাইওয়ে। আমরা ছুটছি সেদিকে।  কারন আমি প্রথমে যাবো প্রাচীন রাজধানী বাগান হয়ে মান্দালয়। ফেরার পথে রুখবো রেঙ্গুনে।

 

রমজান মাস চলছে, কিছুক্ষণ পর ইফতার। মোরশেদ আর মাবুদ দুইজনই রোজাদার। আমাকে টার্মিনালে পৌঁছে দিয়ে একটি দাওয়াত রক্ষায় মোরশেদ যাবেন রেঙ্গুনের পশ্চিম শহরতলীর ইনসেইনে আর মাবুদ নিজের বাড়ি। আবদুল মাবুদের কথা শুনে মনে হলো তার পূর্বপুরুষ রোহিঙ্গা। তিনি মোরশেদের সঙ্গে মেতে আছেন। মওকা বুঝে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বদ্দার বাড়ি হঁড়ে?’ প্রশ্ন শুনেই মাবুদ ঘাড় ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। মনে হলো এতক্ষণ তিনি আমাকে খেয়ালই করেননি। তারপর বললেন- আঁরার জন্ম ত এঁড়ে, রেঙ্গুন’ (আমাদের জন্ম এখানে, রেঙ্গুনে)। ফের প্রশ্ন করলাম- ‘ইয়ান ত অঁনর হতা উনি বুজ্জি। কিন্তু অঁনর বাপ-দাদার ঘর হড়ে ইয়ান পুচার গরিদ্দে।’ আবদুল মাবুদ ফের ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘আঁর দাদার বারি আইক্কাব?( আমার দাদার বাড়ি আকিয়াব)। গল্প জমে উঠার আগে ট্যাক্সি থামলো অং মিনগালার বাস টার্মিনালে। পরিচ্ছন্ন বাস টার্মিনালে পা রেখে আমার লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কথা মনে পড়লো। মহাখালী বা বহদ্দারহাটের নোংরা টার্মিনাল দেখতে দেখতে অংমিঙ্গলার এত পরিচ্ছন্ন টার্মিনাল আমার কাছে মনে হলো অভিজাত বাড়ির উঠোন। সিমেন্ট ঢালাই মেঝেতে ময়লা-আবর্জনা তো দূরের কথা খুব একটা ধূলোবালিও নেই। টার্মিনালে সাকুল্যে গোড়া বিশেক গাড়ি দাঁড়ানো। বেশিরভাগই বাতানুকূল। কান ঝালাপালা করে তোলা হর্ন, যাত্রীদের ভীড়, চিৎকার চেচামেচি কিছুই নেই।

পরিচ্ছন্ন বাস টার্মিনাল

আমার সিগারেটের অভ্যাস পুরোনো কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে স্টকশূন্য অবস্থায় বিমানে চড়েছি। মায়ানমারে কি বেনসন পাওয়া যায়? মোরশেদ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললেন, না। আমাকে উৎকণ্ঠিত হবার কোন সুযোগ না দিয়েই সমাধানের পথ বাতলে আবদুল মাবুদকে সিগারেট আনতে পাঠালেন। চেরাগ ঘষা জ্বিনের মতো পরক্ষণেই তিনি সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে হাজির। জাপানী অরিজিন ‘মেভিয়াস’ ব্রান্ড। ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত থাকে সে ক্ষতির শিকার অসুস্থ মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বীভৎস ছবি। কিন্তু প্রেমিকার খুঁত যেমন প্রেমিকের চোখে পড়ে না তেমনি আসক্তের মনে রেখাপাত করতে পারে না সে বীভৎস ছবি। বারবার সে ছবি দেখেও দিব্যি ধুমপান করে কোটি মানুষ। এ এক অ™ভুত ব্যাপার। মায়ানমারে সিগারেটের প্যাকেটে তেমন কিছুর মুদ্রণ নেই।

আবদুল মাবুদের পিছু পিছু আমরা একটি কাউন্টারে ঢুকলাম। এলিট এক্সপ্রেস, বাস সার্ভিসটির কথা আমি ইন্টারনেটেও পড়েছি। কাউন্টারে ঢুকেই আমার চোখ বিস্ময়ের তড়িতাহত হলো। কাউন্টার সামলাচ্ছেন ছোটখাটো গড়নের একদল বার্মিজ তরুণী। মার্বেলের মতো গোল গোল চোখ মেলে তাদেরই একজন জানতে চাইল কোথায় যাবো? আবদুল মাবুদ বাগানের কথা বলতেই তরুণীটি পাশেরজনকে দেখিয়ে দিয়ে নিজেদের ভাষায় কি যেন বলল হাসিমুখে। নির্ধারিত কাউন্টারের তরুণীটির সঙ্গে একচোট কথা বলে নিল আবদুল মাবুদ। রেঙ্গুনসূত লোকটির মুখে খৈয়ের মতো ফুটল বার্মিজ ভাষা। পরক্ষণে বাংলায় তরজমা করলেন- ‘বাস ছাড়বে সাড়ে আটটায়, পৌঁছোবে ভোর ৫টায়; ভাড়া চৌদ্দ হাজার কিয়েট।’ সময় নিয়ে সমস্যা নেই কিন্তু চৌদ্দ হাজার সংখ্যাটা কেমন বিপুল-বিশাল ঠেকল আমার অনভ্যস্ত কানে। মনে মনে হিসাব কষতে শুরু করলাম, দুইশ ডলার সমান দুই লক্ষ চৌত্রিশ হাজার কিয়েট হলে চৌদ্দ হাজার কিয়েট সমান কত ডলার? মোরশেদ হেসে বললেন, ‘ঠিকই আছে, দিয়ে দেন। মায়ানমারে কেবল থাউজেন্ড শুনবেন, আর জলের মতো খরচ হবে। কিন্তু দিন শেষে দেখবেন- লাখে লাখে সৈন্য মরে, কাতারে কাতার, হিসাব মিলিয়ে হবে মাত্র ক’হাজার।’ তাহলে একেই বলে মুদ্রা মানের সার্কাস নৈপূণ্য! 

প্রতিবেশী দেশ হলেও মায়ানমান সম্পর্কে আমাদের জানাশোনার পরিধি তেমন বিস্তৃত নয়। বিদায় নেবার আগে মোরশেদ আমাকে প্রয়োজনীয় কিছু পরামর্শ আর অভয় দিলেন বারবার। যে কোন সময় যে কোন ধরনের সমস্যা মনে করলে বা পড়লে আমাকে ফোন দেবেন। বিদেশ বিভূঁইয়ে এ অভয়টিই হয়ে ওঠে আমার আত্মবিশ্বাসের বিশ্বস্ত সহযোগী। টিকেট কেটে বাইরে বেরিয়ে খেয়াল করলাম ডুবি ডুবি করছে সূর্য। বিদেশ বিভূঁইয়ে ইফতারের আগমূহুর্তে স্বল্পপরিচিত দুইজন রোজাদারের কষ্ট বাড়াতে পারি না। আমাকে বিদায় জানিয়ে তারা চলে গেলেন যে যার গন্তব্য অভিমুখে।

বাস ছাড়বে রাত সাড়ে আটটায়। হাতে পাক্কা আড়াইঘন্টার ওপরে অলস সময়। নতুন দেশে নতুন ব্রান্ডের প্রথম সিগারেটটি ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সিদ্ধান্ত নিলাম টার্মিনালে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। কাঁধে ভারি ব্যাগ, ধীর পদক্ষেপ। টার্মিনালে রামবুটাম, সিদ্ধ বাদাম আর সিদ্ধ ভুট্টাসহ নানারকম আচারের প্যাকেট নিয়ে বসেছে কিছু ছোট ছোট দোকান। টার্মিনালে বেশকিছু খাবারের দোকানও আছে। নারীরাই পরিচালনা করছে সেসব। দোকানে ভীড়ও নেই আবার ক্রেতাশূন্যও নয় কোনটি। দুপাশের দোকানপাট দেখতে দেখতে অংমিঙ্গলার হাইওয়ের মুখে পৌঁছতেই দেখলাম রাস্তার ধারে ফাস্ট ফুড নিয়ে বসেছে একটি ছেলে। আমাদের ঢাকা বা চট্টগ্রামে যেমন রাস্তার ধারে ভুড়িভাজা, ডিমপরোটা আর ভাপাপিঠা ইত্যাদির দোকান বসে। ছেলেটির সামনে দুইথালা সমুচা ও রোল জাতীয় তেলেভাজা বৈকালিক নাস্তা। তার একটি ছবি তোলার অনুমতি চাইলে সহাস্যে তা মঞ্জুর করল সে। ছবি তোলা শেষ হলে তার খাদ্যপন্যের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। ছেলেটি ঠিক মঙ্গোলীয় গড়নের নয়, চেহারা সুরতে ভারতীয় বিশেষত তামিল ছাপ। আমি তার সন্ধ্যাকালীন বিক্রিমঙ্গল কামনা করে সামনে এগোলাম। টার্মিনালের উত্তর-পূর্ব কোনায় মিঙ্গালারডন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের গেট। সেখান রাস্তার পাশে এক কোনায় বলের মতো একটি জিনিষ দিয়ে খেলছিল কয়েকজন তরুণ। ফুটবলারদের পায়ের কসরতের মতো তারা পরস্পরকে পায়ে পায়ে পাস দিচ্ছেন শূন্য থেকে শূন্যে। খেয়াল করে দেখলাম গোলকটি বড় বড় ছিদ্রযুক্ত বেতের তৈরি এক হস্তশিল্প। পরে জানলাম খেলাটির নাম সিনলুন। 

অস্ত গেলে কাউন্টারে ফিরে এলাম। কাউন্টারের মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে অনর্গল কথা বলছে আর হাসছে। যেন আজ কোন উৎসবের রাত। ভাবছি, জীবন কি এতটাই আনন্দপূর্ণ মায়ানমারে! তাদের কথাবার্তার একটি বর্ণও আমার বোধগম্য হচ্ছে না। মনে যত কৌত‚হলই থাকুক কোন তরুণীর মুখের দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকা নিশ্চয় ভদ্রোচিত নয়। মোবাইলে চার্জ দিতে দিতে আড়চোখে দেখছি মেয়েগুলোর গল্প-হাসি। মাঝে-মধ্যে দু’চারজন যাত্রী এলে তরিৎ তাদের সামলাচ্ছেন তরুণীগুলো।

নীরব-নিশ্চুপ মাটির পুতুলের মতো কতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা যায়। তার উপর চোখের সামনে যখন একদল তরুণী কাউন্টারে বসে আছে আর তাদের বাক্যলাপগুলো গুঞ্জন তুলছে কানের পর্দায়। কিছুক্ষণ পর আমি যে কাউন্টার থেকে টিকেট কেটেছি সে কাউন্টারের মেয়েটির কাছে এক টুকরো কাগজ চাইলাম। উদ্দেশ্য এক ঢিলে দুই পাখি মারা। রেঙ্গুন শহর, বাগান আর মান্দালয় সম্পর্কে তথ্য জেনে নেয়ার পাশাপাশি সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে মাগনা বাতচিত। মেয়েটি কম্পিউটার প্রিন্টার থেকে দুই শিট কাগজ এগিয়ে দিলেন। থ্যাংক ইউ বলে পকেটে হাত দিয়ে খেয়াল করলাম কলম নেই। মনে পড়ল বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন ফরম পুরণের সময় টেবিলে ফেলে এসেছি। মেয়েটি আমার হাবভাব দেখে একটি কলম এগিয়ে দিলেন। দ্বিতীয়বার থ্যাংক ইউ বলে বিমানবন্দর থেকে সংগ্রহ করা রেঙ্গুন শহরের ম্যাপটি মেলে ধরলাম। থেকে থেকে মেয়েটিকে নানা প্রশ্ন করছি। বাগান যাত্রাপথে কোথায় গাড়ি থামবে, বাগান থেকে মান্দালয়ের রাত্রীকালীন বাস পাওয়া যায় কিনা, টার্মিনাল থেকে রেঙ্গুন ডাউন টাউনে যেতে কতক্ষণ লাগে, কত নাম্বার গাড়ি ধরতে হয়...। মেয়েটি স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রশ্নগুরোর জবাব দিচ্ছে। তার আচরণে বিরক্তির লেশমাত্র দৃশ্যমান নয়। যেটা সে জানে না সেটা অন্যদের কাছে জেনে বলছে।

কিছুক্ষণ পর কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল তাম্বুল বিলাসী এক লোক। মুহূর্তেই সে ঢুকে পড়ে মেয়েগুলোর আড্ডায়। আমার হাতে রেঙ্গুন শহরের ম্যাপ দেখে লোকটি যেচে জানতে চায়- আপনি কোথায় যাবেন? আপনি কি ভারত থেকে এসেছেন? আমি কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়েই বললাম, বাংলাদেশ। কথা নেই, বার্তা নেই, ধুম করে প্রশ্ন করে বসলো- আপনি কি বুড্ডিস্ট? আমি মাথা নেড়ে ‘না’ সুচক জবাব দিতেই ফের প্রশ্ন করলো- তাহলে কি মুসলিম? যথারীতি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সুচক জবাব দিতেই লোকটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমিও’।   

এবার সরাসরি লোকটির চোখের দিকে তাকালাম। এতক্ষণ বার্মিজ ভাষায় তরুণীদের সঙ্গে কথা বলল কিন্তু তার চেহারা বলছে তিনি ঠিক বার্মিজ নন। তার মানে পুর্বপুরুষ বহিরাগত। মায়ানমারে মুসলমানদের নানা দুর্দশার এত গল্প শুনেছি যে, কারও মুখে ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন শুনে মনে একটু সংশয়ও তৈরি হলো। লোকটি কে? কোন গোয়েন্দা সংস্থার লোক না তো! এবার আমি সরাসরি তার পরিচয় জানতে চাইলাম। আমার প্রশ্ন শুনে তাম্বুল রাঙ্গা ঠোঁট মেলে একগাল হেসে বললেন, আমি এলিট সার্ভিসের একজন চালক। মুহূর্তেই আমার মন থেকে ভয়-সংশয়ের পাথরটি নেমে গেল। 

লোকটির নাম ইউ থিয়েন থো উ ওরফে কাম্মার হোসেন। তার পূর্বপুরুষেরা মায়ানমারে এসেছেন ভারতের তামিলনাড়ুর কোন এক গ্রাম থেকে। অংমিঙ্গলার টার্মিনাল থেকে মাইল বিশেক উত্তরে তার বাড়ি। কাম্মার হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে আমিই হয়ে ওঠলাম তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। কাম্মার হোসেন রেঙ্গুনের কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের লোকেশন ও যাতায়াতের ব্যাপারে খোঁজ-খবর দিল। আর রেঙ্গুনে ঈদ করবো জেনে বললেন, ডাউন টাউনে অনেক বাঙালীর বসবাস।

গল্প করতে করতেই কাম্মার হোসেন জানতে চাইলেন, রাতের খাবার খেয়েছেন তো? ততক্ষণে তার উপর আস্থা তৈরি হয়েছে। ক্ষুধার রাক্ষসও উঁকি দিল মওকা পেয়ে। দুরে কোথাও গেলে আমি ভারী খাবার খাওয়ার আগে দশবার চিন্তা করি। পথে কোন ধরনের পেটের পীড়া আমার কাছে আতঙ্কের নাম। ব্যাগটি কাউন্টারে মেয়েটির জিম্মায় রেখে কাম্মার হোসেনের সঙ্গে বের হলাম রাতের খাবারে। কাম্মার জানালেন, এখানে হালাল খাবার দু®প্রাপ্য নয়। কিন্তু বেশিরভাগ দোকানে নিজস্ব রেসিপির এত তরকারি রান্না হয় যে, হালাল খাবারটিও সন্দেহমুক্ত থাকে না। তার কথা শুনে আমি একটু দমে গেলাম। কিন্তু অভয় দিয়ে তিনি বললেন, টার্মিনালের সামনের দিকে অংমিঙ্গলার সড়কে মুসলমানদের একটি বিরিয়ানীর দোকান আছে। দেশেও খুব একটা বিরিয়ানী খাই না, মোদ্দা কথায় ভোজন রসিক নই। কিন্তু মায়ানমারে বিরিয়ানীর স্বাদ নিতে কিছুটা সিক্ত হল জিব। কাম্মারের তার পিছু নিলাম। কিন্তু অংমিঙ্গলার রোড়ে পৌঁছতে না পৌঁছতে বাংলা সিনেমার গানের দৃশ্যের মতো ঝুপ করে নামলো হঠাৎ বৃষ্টি। মনে পড়লো শহীদ কাদরীর ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ কবিতাটি-

 

‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘর-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে

যারা তন্দ্রালস দিগি¦দিক ছুটলো, চৌদিকে

ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মত যেন বা মড়কে

শহর উজাড় হবে, -বলে গেল কেউ- শহরের

পরিচিত ঘণ্টা নেড়ে খুব ঠাণ্ডা এক ভয়াল গলায়

এবং হঠাৎ

সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে

বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম!

বজ্র-শিলাসহ বৃষ্টি, বৃষ্টি : শ্রুতিকে বধির ক’রে

গর্জে ওঠে যেন অবিরল করাত-কলের চাকা,

লক্ষ লেদ-মেশিনের আর্ত অফুরন্ত আবর্তন!

নামলো সন্ধ্যার সঙ্গে অপ্রসন্ন বিপন্ন বিদ্যুৎ

মেঘ, জল, হাওয়া,

হাওয়া, ময়ুরের মতো তার বর্ণালী চিৎকার,

কী বিপদগ্রস্ত ঘর-দোর,

ডানা মেলে দিতে চায় জানালা-কপাট

নড়ে ওঠে টিরোনসিরসের মতন যেন প্রাচীন এ-বাড়ি!

জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় জনারণ্য, শহরের জানু

আর চকচকে ঝলমলে বেসামাল এভিনিউ

এই সাঁঝে, প্রলয় হাওয়ার এই সাঁঝে

(হাওয়া যেন ইস্রাফিলের ওঁ)

বৃষ্টি পড়ে মোটরের বনেটে টেরচা,

ভেতরে নিস্তব্ধ যাত্রী, মাথা নীচু

ত্রাস আর উৎকণ্ঠায় হঠাৎ চমকে

দ্যাখে, জল

অবিরল

জল, জল, জল...’

 

আমি কাম্মারের পিছু পিছু আমিও দৌঁড়াতে লাগলাম। কাম্মার দৌড়ের মধ্যেই একটি দোকানে ঢুকে পড়লেন। আধভেজা শরীরে সে দোকানে ঢুকেই ভাবলাম এটাই বুঝি সে বিরিয়ানীর দোকান। কিন্তু কাম্মার একটি ছাতা ধার করে আবারও রাস্তায় নামলেন। একছাতার নিচে মাথা বাঁচিয়ে আধভেজা শরীরে হাঁটছি দুজন। বৃষ্টির তোড়ে প্যান্টের নিচের অংশ তখন চুপচুপে। কিছুটা অধৈর্য্য হয়েই বললাম, কাম্মার ভাই- আর কতদূর? কাম্মার হোসেন বললেন, ওই তো সামনে। মনে মনে ভাবছি, কাকভেজা শরীরে বিরিয়ানী ভোজন! কয়েকমিনিট পর রাস্তার ধারে সে বিরিয়ানীর দোকানে পৌঁছলাম। দুই মিনিটের মধ্যেই চিকেন বিরিয়ানীর পার্সেল প্যাকেট আর আড়াই হাজার কিয়েটের একটি- স্লিপ ধরিয়ে দিল দোকানী।

টার্মিনালে ফিরতে ফিরতে কাম্মার বললেন- বাগান যাচ্ছেন ভালো, কিন্তু একটু সাবধানে ঘুরবেন। আমার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে বললেন, আপনি একে মুসলমান তার ওপর বাংলাদেশি। বাগান জায়গাটি আরাকানের কাছেই, ইরাবতি নদীর এপার-ওপার। সেখানে বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী আর কিছুটা জাত্যাভিমানী। আবার বাগান মুসলমানদের পছন্দের জায়গায় নয়, অপ্রয়োজনে তারা সেদিকে পা বাড়ায় না। আপনি পারতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বা মুসলমান এসব পরিচয় দেবেন না। আমি ঘাড় নেড়ে তার পরামর্শের প্রতি সম্মান জানালাম। যদিও মোরশেদ অভয় দিয়ে বলেছেন আরাকান ছাড়া গোটা মায়ানমারে আপনার কোন সমস্যা নেই। টার্মিনালে চত্বরে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে কাম্মার হোসেনের বাসটি স্টার্ট দিয়েছে হেলপার। তিনি বিদায় জানিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলেন। এ বিশ্বাস গাঢ় হলো যে, জগতের সব মানুষ নিশ্চয়ই স্বার্থপর নয়, মানুষের মন থেকে পরোকারিতাবোধ এখনও লুপ্ত হয়ে যায়নি।

এলিট সার্ভিসের কাউন্টারটি টার্মিনালের এক কোনায়। কাউন্টারে এতগুলো মানুষের সামনে বিরিয়ানী চিবানো নিশ্চয় শোভনীয় দৃশ্য তৈরি করবে না। পাশেই কয়েকটি খাবার দোকান। খাবারের জন্য হোটেল আদর্শ স্থান কিন্তু এক দোকানের খাবার আরেক দোকানে বসে খেতে চাওয়াও লজ্জ্বার। বিরিয়ানীর প্যাকেট নিয়ে তার একটিতে ঢু মারলাম। একজন মধ্যবয়স্কা বার্মিজ নারী খাবার পরিবেশন তদারক করছিলেন। হাতের প্যাকেটটি দেখিয়ে বললাম, সিস্টার আমি কি আপনার দোকানে খাবারটি খেতে পারি?

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মহিলা ইশারায় খালি একটি টেবিলে বসতে বললেন। বার্মিজ ভাষায় তার নির্দেশ পেয়ে একটি কিশোরী খালি প্লেট আর জগভর্তি পানি এনে দিলেন টেবিলে। হোটেলে খুব একটা ক্রেতা নেই। আমার উল্টোপাশে বসে ভাত আর বার্মিজ ঘরনার স্যুপ খাচ্ছিলেন এক মধ্যবয়স্ক।

প্যাকেটের বিরিয়ানী প্লেটে ঢালতেই বেরিয়ে এলো দেশি মুরগীর লম্বা চিকন ঠ্যাং। লম্বা চালের ভাতগুলো আঙুলে স্পর্শ করেই বুঝলাম ঠাণ্ডা। কিন্তু সেটা মুখে দিতেই বিস্বাদ ঠেকল। একে তো ঠাণ্ডা তার ওপর মশলার ব্যবহার প্রায় নগন্য। বিরিয়ানীর বিস্বাদে ক্ষুধাটাও চাঙে উঠল। বিরিয়ানির ব্যাপারে একটি কথা চালু আছে-‘চাল মশলা ঘি মাংস আর সুগন্ধির এমন অটুট মিশ্রণ- মুখে ফেললে পারিজাতের গন্ধে স্বর্গোদ্যান ভ্রমণ!’ কিন্তু এ অংমিঙ্গলার টার্মিনালে ঠান্ডা বিরিয়ানী খেয়ে আমার বাগান ভ্রমণটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে কিনা সে চিন্তার রেখা ফোটালো কপালে। ততক্ষণে আমার টেবিলের সামনে এসে বসলেন এক বৃদ্ধা। চুপচাপ আমার খাবার গ্রহণ দেখছেন। বার্মিজ মহিলাটি বললেন, ইনি আমার মা। কিন্তু আমি দুইজনের মধ্যে কোন মিল খুঁজে পেলাম না। যার চেহারা মঙ্গোলয়েড তার মায়ের চেহারা কিভাবে আমাদের মতো শ্যামলা হয়!

আমি দুইজনের দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকালে ভদ্রমহিলা বুঝলেন তাদের অমিলই আমার এ বিস্ময়ের কারণ। এবার তিনি হেসে বললেন, আমার বাবা স্থানীয় বুড্ডিস্ট আর মায়ের পূর্বপুরুষ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তামিল। আমি নাকি বাবার মতোন হয়েছি। বলেই তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন। বৃদ্ধা আমার কাছে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চাইলেন আমি ভারতীয় কিনা। বাংলাদেশী বললেও তার সে আন্তরিক চাহনিতে মলিনতার ছাপ পড়ে না। যে কিশোরীটি খাবার পরিবেশন করছিল সেটা বৃদ্ধার নাতনি। তিন প্রজন্ম মিলে চালাচ্ছেন এ খাবার দোকান। বৃদ্ধা ক্যাশে বসেন, ভদ্রমহিলা অর্ডার নেন আর কিশোরীটি পরিবেশন করেন। দারুণ এক পরম্পরা। বৃদ্ধা ও তার মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে বিরক্তি লুকিয়ে গলাধকরণ করলাম বিরিয়ানীর এক-তৃতীয়াংশ। বৃষ্টি ভেজা শরীরে বরফকুচির মতো ঠান্ডা বিরিয়ানীর বিস্বাদ হজম করতে এককাপ গরম চা খেয়ে ফিরে এলাম কাউন্টারে।

 

[চলবে...] —

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন