ভ্রমণে শেখার আছে কতকিছু

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

জীবনে দেশ ভ্রমণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর নেই। কত স্মৃতি, কত জানার কথা সব সঞ্চিত হয়ে থাকে অন্তরের মণিকোঠায়। তেমন কিছু অভিজ্ঞতা নিজের ঝুলি থেকে বের করার একটি ক্ষীণ প্রয়াস এই লেখা। খুব ঘটা করে ভ্রমণ করা যায় না। অনেকে এমন ধারণা করেন যে ভ্রমণ মানে নিজের ব্যাংকের হিসাব থেকে বেশ কিছু টাকা খসানো। বিষয়টি যেভাবে বলা হয় তা সত্যি নয়। একটু চোখ কান খোলা রাখলে ভ্রমণ আপনার জীবনে বাড়তি কোনো চাপ নয়। নিজের মাসিক বা বার্ষিক বাজেটে ভ্রমণও থাকবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে, এ যেন অবশ্য কর্তব্য হয়। তাহলে ভ্রমণ করা যাবে সাশ্রয়ী উপায়ে।

অনেকে মনে করেন জীবনে কেবল অর্থ উপার্জনই সার কথা, কিন্তু তবু কিছু সময় রাখতে হবে বিদেশে প্রবাসে ঘুরে কিছু স্মৃতি মণিকোঠায় সঞ্চয় করে রাখার জন্য। এমন কিছু মজার মজার ঘটনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। কথায় আছে না, কাবুল যাবেন আর কাবুলিয়ালা হবেন না, তাই কি হয়? একইভাবে যখন রোম যাবেন তখন রোমান হবেন এটাই স্বাভাবিক। রোমে গিয়ে বাংলাদেশি খাবার খুঁজলে হবে না। রোমকে পুরোপুরি বুঝতে হলে সে দেশের আহার, সংস্কৃতির স্বাদ নিতে হবে অবশ্যই। হয়তো ইতালিয়ান বা গ্রিক খাবারের জন্য বেরিয়েছিলেন সেজন্য জর্জিয়ান খাবার যে আপনার জীবনকে বদলে দেবে না তা-ও নয়। অবশ্য জর্জিয়ান খাবার আমার অভিজ্ঞতায় পৃথিবীতে সেরা খাবারের একটি।

দেশে দেশে যত গেছি সেসব অঞ্চলের খাওয়া-দাওয়ার কোনো একটির জন্য আমার জিভে জল সরেনি তেমন নয়। কয়েকটি খাবার অবশ্য চেষ্টা করে হলেও খেতে হবে। আর ভ্রমণে নানা কিসিমের খাবারের স্বাদ নেয়া কেবল স্বাদের জন্যই নয়, এ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, হয়তো সেই অভিজ্ঞতা সেই দেশকে আপনার কাছে তুলে আনবে অনন্য এক রূপে। হয়তো সেসব রান্নার রেসিপি জেনে নিজের পাকশালে চেষ্টা করলে ক্ষতি কি? নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে না গেলে নিজ দেশের মহত্ত্ব ও মাধুর্য বোঝা যায় না।

আমি বাংলাদেশ না ছাড়ার আগে বুঝিনি বাংলাদেশি হওয়ার মানে কি? বাঙালি হওয়ার মানে কি? বিদেশে আমি দেখেছি আমার দেশ সমৃদ্ধ সেখানকার লোকজনের জানাশোনা উপলব্ধি। আমার নিজের অনুভূতিকে সে সঙ্গে মিলাই, হৃদয়ে অনুভব করি দেশের মাটির সোঁদা গন্ধ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যাতায়াত, সবকিছু সমৃদ্ধ নানা দেশে কত বিভিন্ন মত আর আমার দেশের সঙ্গে কোন মডেলটি খাপ খাইয়ে যায়। ক্রিকেট খেলায় যখন বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের জয়ে উল্লসিত মাঠ, প্রবাসে সেদিন মাঠে আমার মুখও লাল সবুজ রঙের। সেদিন আমি সত্যি বুঝলাম আমি বাঙালি। অন্য দেশের ভাষা অল্পস্বল্প না জানলেও অনেক পার্থক্য ঘটে যায়। সময়ের পরিক্রমায় হয়তো এটুকু শিক্ষা হয়েছে। ভাষা অল্পস্বল্প জানাতে সে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সামান্য জেনেছি। দোকানদারও সমীহ করে কেনাবেচা করে। বেশি বিক্রয়মূল্য হাঁকে না। আহারের টেবিলেও আসে স্বস্তি রেস্তোরাঁয়। যেসব স্থান সম্বন্ধে জানেন কম সেসব স্থানে ভ্রমণ করতে হবেন উৎসাহিত আমরা স্বীকার করি বা না করি বিশ্ব ইতিহাস প্রধানত মহা শক্তি বা পরাশক্তিদেরই উচ্চে তুলে ধরে আর সে জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি কম। গভীরভাবে জানতে পারি না। তাই ভ্রমণ করলে অবিশ্বাস্যভাবে সেই সুযোগ হাতের নাগালে এসে যায়।

পৃথিবীর মানচিত্রকে একটি শূন্যস্থান হিসেবে দেখে সেই শূন্যস্থানের কোনো বিন্দুতে পা ফেলে সে স্থলে রঙিন আলপনা আঁকার মধ্যে আছে আবিষ্কারের আনন্দ। এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়ন ভ্রমণ করতে গিয়ে। কি দারুণ অভিজ্ঞতা, কি বিচিত্র সংস্কৃতি, তাদের জনজীবন ও ইতিহাস। ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে অতি ভাবনার হেতু নেই ট্রিপের জন্য প্রস্তুতি নিন, কিন্তু সেজন্য ভারত ভ্রমণের আগে লাইব্রেরি থেকে সে দেশের ভ্রমণ সম্বন্ধে সবগুলো গাইড বুক কেনার দরকার নেই। আমার সবিনয় নিবেদন, যাওয়ার আগে সে দেশ সম্বন্ধে এত জানার প্রয়োজন বাহুল্য বটে। দেখে দেখে শেখা, ঠেকে ঠেকে শেখা, কিছু দরকারি তথ্য জানা এটুকু হলেই হলো। তাই তো ভ্রমণের রোমাঞ্চ। আমি গঙ্গা পাড়ে তীর্থ দর্শনে বেরিয়ে আমিও আমার স্ত্রী এভাবে ঘাটে ঘাটে শিখেছি নানা কিছু। বেশ বাধা বিপত্তি ছাড়াই উতরে গেছি ভ্রমণ পর্ব। মাঝে মধ্যে বাধা বিপদ সামান্য যা এসেছে এদের অতিক্রমের আনন্দও উপভোগ করেছি। গা শিউরে উঠা কিছুক্ষণের পর স্বস্তির ক্ষণ উপভোগ বড়ই আনন্দের।

আমরা এমন এক যুগে বাস করি যে যা কিছু আমরা চিত্রে প্রদর্শন করি তাতেই পাই প্রশংসা। কোথায় ভ্রমণ করলাম তা তেমন যেন যায় আসে না। কি অভিজ্ঞতা হলো তাতে আমাদের কৌতুহল কম। ছবি দেখেই আনন্দ বেশি। তবে চিত্রশিল্পী, আলোক চিত্রশিল্পী, ব্লগার বা সোস্যাল মিডিয়া একটিভিটিস্ট সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য থাকা চাই। কোনওটির অতিশয্য ভালো নয়। তাই ক্যামেরা  যেন ধরে রাখে ভ্রমণের স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো। সে দেশে কোনো অনিন্দ্য সুন্দর সূর্যাস্ত বা কোনো দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ছবি হবে স্মৃতিময়। হয়তো সেসব দেশে যেসব লোকের সঙ্গে দেখা হবে এদের জন্য জীবন যাবে বদলে। হয়তো ভিন দেশে কোনো অঞ্চলে বেশকিছু দিন থাকা হয়েছে, সে দেশে কোনো একটি ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে দয়া, সহমর্মিতা আর সততার নিদর্শন। সেরকম হতে চাইতে পারে মন, নিজেকেও বদলে নিতে চাইবে মন। থাইল্যান্ডে এমন অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এরকম কত উদাহরণই তো আছে।  

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন