ভালবাসার এক ব্যতিক্রমী গল্প

হোসাইন জাকি

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর! প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সুনাম নিয়ে আমাদের অন্যান্য চিড়িয়াখানাগুলো যখন ইমেজ সঙ্কটে; চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে তখন মাতৃসম মমতায় বাঘ-সিংহকে দেখাশুনা করছেন ওয়াইল্ড লাইফ স্কাউট রাজিব দেব। এই পার্কটি ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক নামেও পরিচিত। নিজ চোখে না দেখলে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাণীর প্রতি এমন মমত্ববোধ বিশ্বাস করা সুকঠিন। এটি বছর দুয়েক আগে এক শীত বিকেলের কথা।

সর্বপ্রথম যখন পার্কে শিশু বাঘদুটোকে আনা হয়, তখন থেকেই তাদেরকে ফিডার দিয়ে দুধ খাইয়ে বড় করেছেন রাজিব। পালা গরুকে আমরা যেমনটা আদর করি, ঠিক তেমন ভাবেই। বাঘগুলোর কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিও ছিল দেখার মতো। সিংহের আচরণও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সিংহের কেশর ধরে রাজিব আদর করে দিচ্ছিল, আর সিংহটা তা উপভোগ করছিল। সিংহটাকে হুংকার দিতে বলার সঙ্গেই সঙ্গেই হুংকার দেয়। তাকে আরও জোরে হুংকার দিতে বলায় দ্বিতীয়বার গর্জনের মাত্রা বেড়ে যায়। তবে বেরসিক বাঘ অসময়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আমার দিকে ঝর্ণাধারা প্রবাহের প্রচেষ্টা নেয়। সঙ্গে থাকা বাচ্চারা চিৎকার করে সাবধান না করলে আরেকটু হলেই সাঙ্গ হতো আমার স্নান করার পালা!

রাজিব ও বাঘের মিতালি

যার কাজ তারেই সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে। প্রাণী সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন ও প্রাণীর প্রতি বিন্দু পরিমাণ মমত্ববোধ ছাড়াই চাচা-মামা ধরাধরি করে যারা বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত হন, তাদের কাছে তা নিরাপদে থাকবেনা সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সীমিত সম্পদ ও জনবল নিয়ে দেশের যত্রতত্র চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করাও বোধ করি প্রজ্ঞার পরিচয় নয়। যে কারণে দেশের অধিকাংশ বন ও বন্যপ্রাণীর অবস্থা সঙ্গিন। ব্যতিক্রম পেলাম ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে সপরিবারে ভ্রমণে গিয়ে।

শুরুতেই উন্মুক্ত স্থানে বানরের সাক্ষাৎ। রাস্তা জুড়ে বানর। পাশ্ববর্তী ঝোপঝাড়ে বানর। পার্ক কর্তৃপক্ষের পরামর্শ মতো, বিস্কুট-চিপস-কলাজাতীয় খাদ্যদ্রব্য দিয়ে বানরকে অভ্যর্থনা হতে বিরত ছিলাম। ফলে বাচ্চারা নিরাপদেই বানরের সংস্পর্শে বাঁদরামি করার সুযোগ পেয়েছে। সাফারি পার্কটি ২২৫০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত একটি প্রাকৃতিক বনের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে ক্ষণে ক্ষণেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পানিতে ভেসে থাকা পাখীর অভয়ারণ্য ছিল মন কাড়ার মতো। গাড়িতে বসেই পাখির কলকাকলি উপভোগ করলাম। সঙ্গে থাকা শিশুদের সে কি আনন্দ। শিশুদের মা-বাবা-নানীও আনন্দ পেয়েছে নিঃসন্দেহে! ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণীগুলো যে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পাচ্ছে তা বুঝা যায়, কুমিরের খাঁচার রক্ষণাবেক্ষণের আয়োজন দেখে। প্রশস্ত পরিসরে একপাশে বয়স্ক কুমিরগুলো। অন্য পাশে বাচ্চা কুমিরের দল। তাদের নড়াচড়া আর ভাবভঙ্গি দেখে বেশ বুঝা যায়, পানি ও রোদে হেসে খেলে তারা জীবন কাটাচ্ছে। খানা-খাদ্যের কোথাও কমতি হচ্ছে না।

সিংহ ও রাজিবের মিতালী

ছোটবেলা হতে বাড়ির পাশের মিরপুর চিড়িয়াখানায় ক্লান্ত, অবসন্ন হাতি দেখতে দেখতে বোধ করি হাতির স্বরূপই আমার কাছে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। তাই সপ্রতিভ হাতির পিঠে বসা মাহুতকে দেখে রাজার হাতি বলেই ভ্রম হচ্ছিল। হাতিটাও ভারি বুদ্ধিমান। অভিবাদন দিতে দেরি করেনি এক মুহুর্ত। পাছে সেলামি ফসকে যায়!

কিছুদূর যেতে না যেতেই জলহস্তীর বিশাল সাম্রাজ্য। প্রথমেই ছিল বাবা-মা আর তাদের এক শিশু জলহস্তি। এখন সংখ্যাধিক্য ঘটে সাত। দর্শক দেখে সার্কাসের প্রাণীদের মতো তারা বিভিন্ন কসরত শুরু করল। ছোট্ট মানব শিশুরা কিছুদিন সাঁতার শেখার পর পানিতে নামলে যেমনটা করে ঠিক তেমনটা। বিভিন্ন ভঙ্গিতে পানিতে ডুবাডুবি খেলা। তবে দশ তলা সমান অকেজো ওয়াচ টাওয়ারটা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পরেছে। চালু থাকলে হয়তো পুরো বনটাকে সুউচ্চ স্থান হতে এক নজর দেখার সুযোগ হতো। আফসোস, অন্যমাত্রার একটা সৌন্দর্য দর্শন হতে বঞ্চিত হলাম। যাহোক, আমাদের দেশের কোন সাফারি পার্ক ভ্রমণ যে এতটা সুখকর ও রোমাঞ্চকর হবে সেটা আমার ভাবনার অতীত ছিল। ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভ কামনা। 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন