বঙ্গদেশে হারানো গ্রিকরা

ট্রাভেলগবিডি ডেস্ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ভেতরের লম্বা করিডর ধরে হেঁটে গিয়ে বামদিকের খোলা মাঠের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে হালকা হলুদরঙা ছোট্ট এক স্থাপনার। স্থাপত্যরীতির দিক থেকে একেবারেই বেমানান জরাজীর্ণ এই স্থাপনাকে দেখে অনেক ছাত্রই-শিক্ষকই হয়তো একে স্রেফ এড়িয়ে গেছেন, কেউ হয়তো কৌতূহলী হয়ে উঁকিঝুঁকিও মেরেছেন, আবার গেটের ওপরে খোদাই করা ‘আঁকাবাঁকা ইংরেজি’ বর্ণগুলো দেখে কেউ কেউ হয়তো স্থাপনাটি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানার চেষ্টা করেছেন। তবে এড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা হয়তো ভাবতেও পারেননি এই স্থাপনাটির সাথে জড়িয়ে আছে হোমার-সক্রেটিসের দেশের ইতিহাস!

আরমানিটোলার আর্মেনীয় গির্জা বা পোগোজ স্কুলের কারণে আর্মেনীয়দের নাম কিছুটা উচ্চারিত হলেও কালের আবর্তে মাউন্ট অলিম্পাসে থাকা জিউসের সন্তানদের কথা ভুলে গেছে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই। টিএসসি কোণে অযত্নে পড়ে থাকা ঐ স্থাপনাটিই পূর্ববাংলার বুকে টিকে থাকা গ্রিকদের একমাত্র চিহ্ন।

টিএসসি-এ গ্রিক মেমোরিয়ালের থ্রিডি মডেল; Image Credit: Nafis Fuad Khan

ঢাকায় ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে সতেরো শতকের প্রথমভাগে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজদের সঙ্গে গ্রিকরাও ঢাকায় আসেন। ভারতে গ্রিকদের আগমন ঘটে ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে। উপমহাদেশে যে সব গ্রিক এসেছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী। অধিকাংশ গ্রিকের ঠাঁই হয়েছিল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে।

১৭৭০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে ঢাকায় দুই শতাধিক গ্রিক বসবাস করতেন। তারা বিশেষত কাপড়, পাট, লবণ ও চুনের ব্যবসা করতেন। এখান থেকে পাট ও কাপড় ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বংশ পরম্পরায় থেকে যান দীর্ঘদিন। তাদের অনেকেই এদেশে মৃত্যুবরণ করেন এবং এখানেই সমাহিত করা হয়।

টিএসসির স্মৃতিস্তম্ভ; Image Credit: Jannatun Nahar Ankan

বহু সময় ধরে গ্রিকরা এখানে বসবাস করলেও বর্তমানে দেশে তাদের কোনো স্থাপত্য নেই বললেই চলে। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গ্রিক কবরস্থানসহ বিভিন্ন জায়গায় যে সব গ্রিক স্মৃতিচিহ্ন ছিল তা সব বিলীন হয়ে গেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক টিএসসিতে রয়েছে এদেশে গ্রিকদের সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্নের। তৎকালে নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী 'ডিমিট্রিয়াস' নামক এক গ্রিক পরিবারের চার সদস্যের স্মৃতিতে নির্মিত একটি সমাধি সৌধ রয়েছে এখানে। আনুমানিক ১৮০০-১৮৪০ সালের দিকে নির্মিত হয় এটি। কিন্তু পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।

টিএসসি ভিতরে সবুজ মাঠের দক্ষিণ কোণায় অবস্থিত এ সমাধিটি। হলুদ রঙের এ সমাধি সৌধটি দেখতে চতুষ্কোণ আকৃতির কুটিরের মতো। ভিতরে প্রবেশের পথ রয়েছে পূর্ব দিকে। চারদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো এটি। ভিতরে প্রবেশের দরজার ওপর গ্রিক ভাষায় লেখা রয়েছে যার বাংলা অনুবাদ- 'তারাই আশীর্বাদপ্রাপ্ত যারা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছে মৃত্যুর জন্য।' ভিতরের দেয়ালে রয়েছে কালো রঙের ৯টি পাথর বা শিলালিপি। এর পাঁচটি গ্রিক এবং চারটিতে ইংরেজি ভাষায় লেখা। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় স্মৃতিস্তম্ভটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এর আগেও হতে পারে। দীর্ঘদিন অবহেলার মধ্যে পড়ে থাকা স্থাপনাটিকে অবশেষে ১৯৯৭ সালে নয়াদিল্লীর দূতাবাসের মাধ্যমে গ্রিক সরকার সংস্কার করার উদ্যোগ নেয় এবং সেই থেকে প্রায়-হলুদরঙা স্মৃতিস্তম্ভটি ওখানেই রয়েছে। 

 

 

তথ্যসূত্র- ঢাকা সমগ্র ০১ - মুনতাসীর মামুন, রোর বাংলা, বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন