প্যারিস মানে লা তুর ইফেল (পর্ব-৫)

মাসুদুল হাসান রনি

 

ফরাসীরা প্যারিসকে আদর করে ডাকেন পারি। আইফেল টাওয়ারকে ডাকেন লা তুর ইফেল। পারি বা লা তুর ইফেলের টানে সারাবিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে প্রতি বছর ১৪.৮ মিলিয়ন পর্যটক প্যারিস ভ্রমনে আসেন। এখানে এসে সবারই প্রথমে দেখতে যাওয়া চাই আইফেল টাওয়ার । বিশ্ববিখ্যাত ল্যান্ডমার্কটি না দেখা পর্যন্ত মনে হবে না আপনি প্যারিস এসেছেন।

২০০৯ সালের মার্চের কোন একরাতে প্রথমবার আইফেল টাওয়ার দেখতে গিয়েছিলাম। সাথে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র বড় ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন নয়ন , বাল্যবন্ধু আতিক ও মিঠু। রাতের আইফেল টাওয়ার যারা দেখেছেন তারা জানেন প্রতি ঘন্টায় ৫ মিনিট টাওয়ারের রঙ লাল, হলুদ,সাদা, নীল আলোয় পরিবর্তন হয়। রাতের বেলায় এ দৃশ্য দেখতে কি যে অপূর্ব লাগে তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো বড়ই কঠিন। তবে দিনের চেয়ে রাতের আইফেল টাওয়ার অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় লাগে। পৃথিবীর অনেক দর্শনীয় স্থানগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। কিন্তু আইফেল টাওয়ারের রাতের সৌন্দর্য দেখে মনে হয়েছে , এটি আমার এ পর্যন্ত দেখা শ্রেষ্ঠতম সুন্দর স্থান।

আইফেল টাওয়ারের সামনে লেখক

এরপর আরো ৮/১০ বার বিভিন্ন জনকে সাথে নিয়ে টাওয়ার দেখতে যাওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে আমার বার্লিন প্রবাসী কাজিন বাবুকে নিয়ে গিয়েছিলাম আইফেল টাওয়ার দেখাতে। আইফেল টাওয়ারে না উঠে সম্পূর্ণ প্যারিস শহরটাকে সহজে দেখা সম্ভব নয়। তাই দর্শনার্থীদের আইফেল টাওয়ারে উঠা চাই। একই সঙ্গে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার দর্শনার্থী আইফেল টাওয়ারে উঠতে পারে। আমার হাইট ফোবিয়ার কারনে কখনোই টাওয়ারের ওপরে উঠা হয়নি। দুই ভাই ঘন্টা দু'য়েক ঘুরে ফিরে বিভিন্ন এংগেল থেকে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যকে দেখি। বলা যায় প্যারিসের প্রধান শোভা হচ্ছে আইফেল টাওয়ার।

১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এই টাওয়ারটি তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক এই টাওয়ার দেখতে আসেন। ফরাসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ওস্তাভ আইফেলের নামানুসারে এই টাওয়ারের নামকরণ করা হয়েছ আইফেল টাওয়ার। পুরো টাওয়ারটি নির্মাণ করতে লোহা লেগেছ ১৮ হাজার ৩৮ টন। আইফেল টাওয়ারের মূল কাঠামো চারটি বিশাল লোহার পিলারের ওপর তৈরি। ২৫০ জন নির্মাণকর্মী দুই বছর পাঁচ মাস কাজ করে তৈরি করেছে এই টাওয়ার।

প্রতি বছরই আইফেল টাওয়ারে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন দর্শনার্থীর আগমন ঘটে থাকে। আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা ১০৮১ ফুট ৭ ইঞ্চি এবং এর ওজন ১০ হাজার ১০০ মেট্রিক টন। টাওয়ারটির আলোকসজ্জায় প্রায় ৩৩৬টি প্রজেক্টর এবং ২০,০০০টি বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছে। ভ্রমণ বা দেখার জন্য সিঁড়ি বা লিফটের সাহায্যে টাওয়ারটির শীর্ষস্থানে ওঠা যায়। সেখানে থেকে প্যারিস নগরীর সৌন্দর্য চমৎকারভাবে উপভোগ করা এবং প্রায় ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত শহরটি দেখা যায়।

টাওয়ারটির আলোকসজ্জায় প্রায় ৩৩৬টি প্রজেক্টর এবং ২০,০০০টি বাল্ব ব্যবহার করা হয়

দূর থেকে আইফেল টাওয়ার দেখতে খুব সরু মনে হলেও আসলে কিন্তু তা অনেক প্রশস্ত ও বিশাল। টাওয়ারের সামনে পিছনে বিশাল চত্বর। দু'পাশে বাগান ও কৃত্রিম ঝর্না রয়েছে।১৮৮৯ সালের ৬ মে দর্শনার্থীদের জন্য টাওয়ার চত্বর খুলে দেয়া হয়। কিন্তু সেই সময় দর্শনার্থীদের ১,৬৬৫টি ধাপ পার হয়ে শীর্ষে পৌঁছাতে হত। এখন তো সিঁড়ির পাশাপাশি লিফট আছে। প্রতি সাত বছর পর পর টাওয়ার রং করা হয়। ৫০ থেকে ৬০ টন রং প্রয়োজন হয়। এটি সম্পূর্ণভাবে রঙ করতে সময় লাগে প্রায় ১৮ মাস! টাওয়ারটির ভেতরে রয়েছে দুটি রেস্তোঁরা। লা ফিফটি এইট ট্যুর আইফেল এবং লা জুল ভার্ন।

আমি আর বাবু ঘুরে ঘুরে ছবি তুলি। আমাদের মতন হাজার হাজার দর্শনার্থী আইফেল টাওয়ারের আশপাশে ঘুরঘুর করছে। কেউ মনের আনন্দে ছবি তুলছে, আবার কেউ পাশ দিয়ে বহমান সেইন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে টাওয়ারের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। নদীতে রয়েছে ক্রুজ লাইন। এখানে পর্যটকেরা নৌভ্রমণের মাধ্যমে আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।

বেশ কিছুদিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম, অস্ট্রেলিয়ান এক প্রতারক আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দিয়েছিল।সেই কাহিনী মনে পড়ে যাওয়ায় বাবুকে বলি, এটা নিয়ে অনেক গল্প আছে। ভিক্টর লাস্টিং নামের এই ব্যক্তি দুইবার আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তাও আবার যারা পুরোনো লোহা-লক্কর কেনেন তাদের কাছে। বিনা পরিশ্রমে চটজলদি অনেক টাকা রোজগার করার চেষ্টা করে এভাবে তিনি নিজের নাম তুলে ফেলেন ইতিহাসের পাতায়।

১৯২৫ সালে নিজেকে সরকারি অফিসার পরিচয় দিয়ে ভিক্টর নিয়ম মেনে টেন্ডার ডাকেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই ডাকে সাড়া দেয় শহরের সবচেয়ে নামী পাঁচ সংস্থা! তাদের মধ্যে ভিক্টর বেঁছে নিয়েছিলেন আন্দ্রে পয়সনকে। একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর পড়ে কর্তৃপক্ষের কাছে এত সুন্দর বর্ণনা দিলেন টাওয়ারের,তা শুনে ক্রেতা এক কথাতেই রাজি হয়ে যান কিনতে! তারপর, ৭০ হাজার ডলারে বেচে দিলেন আইফেল টাওয়ার! যা এখনকার সময়ের কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমান। এরপর প্যারিস ছেড়ে ভিক্টর উধাও হয়ে আত্মগোপন করেন অস্ট্রেলিয়ায়। কিছুদিন সেখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর আবার ফেরেন প্যারিসে। আবারও বেঁচে দেন আইফেল টাওয়ার।

বাবুকে মনযোগি শ্রোতা পেয়ে আইফেল টাওয়ার নিয়ে আমার জ্ঞান ঝেড়ে দেই। বুঝলে, আইফেল টাওয়ার নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে । মঁপাসা'র নাম শুনেছো? বিখ্যাত ফরাসি লেখক ছিলেন। তিনি কিন্তু আইফেল টাওয়ারকে ঘৃনা করতেন। অথচ রোজ আইফেল টাওয়ারের রেস্টুরেন্টে খেতে আসতেন। এ প্রসঙ্গে কেউ একজন জানতে চাওয়ায় উনি বলেছিলেন,প্যারিসে ওই একটি জায়গাই আছে যেখান থেকে আইফেল টাওয়ার দেখা যায় না, তাই রোজ আসি। মঁপাসা আইফেল টাওয়ারের ওপর বেজায় খাপ্পা ছিলেন বলে প্যারিস ছেড়ে অন্যত্র চলেও গিয়েছিলেন।

দূর থেকে আইফেল টাওয়ার দেখতে খুব সরু মনে হলেও আসলে কিন্তু তা অনেক প্রশস্ত ও বিশাল

আমরা দুইভাই রাজ্যের গল্প করে, ঘুরে ফিরে সারা বিকেল কাটিয়ে দেই আইফেল টাওয়ারের বিশাল চত্বরে। হাঁটতে হাঁটতে খুব কাছে চলে যাই। নীচ থেকে দেখে মনে হলো টাওয়ারটি লোহার এক বিশাল জবড়জং খাঁচা, প্যারিসের সৌন্দর্যের সঙ্গে মানায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকতেই টাওয়ারের বিশালত্ব মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়।

ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের সুর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় ফেরার তাড়া দিয়ে রেখেছিল আমাদের চিকিৎসক বোন ফারহানা ইফতেখার। বাবু জার্মান থেকে প্রথমবারের মতন প্যারিস এসেছে। আমি এসেছি পোল্যান্ড হতে। দুইভাইয়ের জন্য বোনের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। এরমধ্যে একবার ফোন দিয়ে তাড়া দিয়েছে, ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলে আসেন। মাসুম চলে এসেছে। রাতের ডিনার একসাথে খাওয়া হবে।

বাসায় ফেরার জন্য আমরা টাওয়ার পেরিয়ে সেইন নদীর দিকে চলে এলাম। তখনো আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। বিকেলের সূর্যের আলোয় নীল আকাশ ভেদ করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আইফেল টাওয়ার।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন