পাথরে লেখা অমর কাব্যগাঁথা

দিবাকর

সকাল ৭টা।  আমাদের টিমের সবাইকে বলে দেয়া হলো দেয়া হলো সকাল সাড়ে সাতটায় বাস ছাড়বে। টাইম মানে টাইম। এটা হবে চীনা টাইম। আমরা সবাই টনটন। অনেকেই যারা অসুস্থতার ছুতো তৈরি করছিল। তাদের চীনা ভাষার শিক্ষক তাই লাওসি হাসতে হাসতে বলে দিলেন তোমরা যারা অসুস্থ সবাইকে হোটেলে দিনভর থাকার ব্যবস্থা করা আছে। যেতে হবে না। তাই লাওশির মিষ্টি হাসি বলে দিচ্ছিল স্টোন ফরেস্ট না দেখলে তোমরাই বঞ্চিত হবে। রাতে লেখার টেবিলে বসে স্টোন ফরেস্ট নিয়ে নানান তথ্য ঝালাই করে নিলাম। কুনমিং থেকে ৮৬ কিলোমিটার দক্ষিণে সাইলন জেলায় অবস্থিত স্টোন ফরেস্ট। প্রকৃতির এক বিচিত্র খেয়াল এই স্টোন ফরেস্ট। চীনা ভাষায় যাকে বলা হয় ‘শিলিন’। ‘শি’ অর্থ পাথর আর ‘লিন’ অর্থ বন। বাংলায় যা দাঁড়ায় পাথরের বন। ইউনান প্রদেশের এই পাথরের বনটি পৃথিবীর অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান।

স্টোন ফরেস্ট

বলা হয়ে থাকে স্টোন ফরেস্ট আজকের এ অবস্থায় আসতে সময় লেগেছে ২৭০ মিলিয়ন বছর। শত শত বছর ধরে সাগরের তলদেশে জমা হওয়া লাইমস্টোন ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে ওঠে আসে পৃথিবীর বুকে। ভূতত্ত্ববিদরা এই স্টোন ফরেস্টকে কার্স্ট টপোগ্রাফি ( Karst topography ) বলে অভিহিত করেছেন। এটি হিমালয় পর্বতমালারই একটি অংশ। ছোট-বড় নানা বিচিত্র পাহাড় ছড়িয়ে আছে ৩৫০ বর্গকিলোমিটার (১৪০ বগমাইল) এলাকাজুড়ে। আর এসব পাথরের খাঁজে খাঁজে রয়েছে নানান ছোট ছোট গুহা বা চোরাই পথ। সেখানকার চোরাইপথে একাকী হেঁটে অনেকেই হারিয়ে যেতে পারে। আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড সোফিয়া আগ থেকেই সাবধান করে দিয়েছিল। সব সামলে যাত্রা শুরু হয়েছিল নির্ধারিত সময়েই। আর ধীরে ধীরে রহস্য উন্মোচিত হয়েছে পাথরে লেখা অমর কাব্যগাথার।

মূল এলাকায় প্রবেশের আগ থেকেই আমরা টের পাচ্ছিলাম ভিন্ন এক জগতে পৌঁছে গেছি। দূর থেকে উঁকি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে পাথরের বন। যে জঙ্গলের বাসিন্দারা সবাই পাথর। রামায়ণে অহল্যা পাষাণীর কাহিনী জানা আছে। যে কিনা পরে আবার অভিষাপ মুক্ত হয়ে ফের মানবী রূপ প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু এখানের আসীমা এখনো পাথর হয়েই আছে। মূল গেটে যাওয়ার আগেই আমাদের মিনিট পনের যেতে হলো ছোট কারে চড়ে। চারপাশের সবুজ বাগান আর লেক পাড় দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো স্টোন ফরেস্টের মূল প্রবেশ দ্বারে। এই কার চালান স্থানীয় ‘ই’ সম্প্রদায়ের নারীরা। যারা সানী সম্প্রদায়ের ‘ই’ এথনিক গ্রুপের। এক সময় স্টোন ফরেস্ট এলাকাতেই ছিল এদের বাস। চার পাঁচটি গ্রাম ছিল ‘ই’ এথনিক বাসিন্দাদের। এখনও একটি গ্রাম অবশিষ্ট আছে। যাদের পুনর্বাসন চলছে। তবে চীন সরকার যখন পুরোপুরি স্টোন ফরেস্ট সবার জন্য উন্মুক্ত করে তখন থেকেই তাদের অন্যত্র পুনর্বাসন করে। কিন্তু এই এলাকায় তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

আসীমা এখনো পাথর হয়েই আছে

সকলের জন্য ১৭৫ আরএমবি দিয়ে প্রবেশ টিকিট নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন সোফিয়া। একেকটি গ্রুপে ভাগ করে সাবধান করে দেয়া হলো সবাইকে। কেউ একা হয়ে গেলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আর সোফিয়া তার উইচ্যাট নাম্বারটি সবাইকে লিখে নিতে বললো যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই। লেক আর ফুল বাগান পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করি স্টোন ফরেস্টে। দলে দলে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। আর ‘ই’ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নর-নারী। যারা হাসিমুখে সবার সঙ্গেই ছবি তুলছেন। চোখ যতদূর যায় বুঝতে চেষ্টা করছি প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়কে। একেকটি পাথর যেন সাক্ষী দিচ্ছে একেকটি বিষ্ময়ের। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে সমুদ্রের বুক চিড়ে বেরিয়ে এসেছিল পাথুরে এক সভ্যতা। যারা থমকে আছে ইউনানের সাইলনে।  ধীরে ধীরে বেশকিছু গুহার ভেতর দিয়ে আমরা পাড় হতেই একটি জায়গা গিয়ে সোফিয়া আমাদের থামিয়ে দিল। বললো, সামনেই আছে পরশ পাথর। যা ছুঁয়ে মনের ইচ্ছে বললে পূরণ হয়। আমাদের সবাই এক বিপুল উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অনেকেইতো একাধিক ইচ্ছের কথা বলতে শুরু করে দিল। তারপর লম্বা সিঁড়ি বেয়ে ওয়াচ টাওয়ার। যেখান থেকে একটি বড় অংশ দেখা যায় স্টোন ফরেস্টের।

 পৃথক পাঁচটি এরিয়া আর পৃথক পাঁচটি সাব এরিয়ায় ভাগ করা হয়েছে এই ফরেস্টকে। মেজর, মাইনর, নাইগো, ডেডিসোই ও চংখু স্টোন ফরেস্ট। আর সাব এরিয়ার মধ্যে হচ্ছে মেজর, মাইনর, ওয়ানিয়াংলিংজি, লিজইয়ানচিং ও পুশাও মাউনটেন এরিয়া। আর এর বেশিরভাগ এলাকা ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায়। চোখ বন্ধ করে ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় সভ্যতার এক অন্যরূপ। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম পাথরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এক কারুকার্যময় ভাস্কর্য চোখে পড়ছিল। একেকটি পাহাড় যেন একেক সংসারের প্রতিচ্ছবি। যদিও কোনোটিই মানুষের তৈরি নয়। কোথাও যেন কৃষক চাষ করছে। কোথাও রমণী দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও একদল মানুষ আড্ডা দিচ্ছে। কোথাও আবার নানান রকমের পশুপাখি দেখা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা প্রতিটি পাথরই যেন শিল্পীর হাতের নিপুণ ছোঁয়া। হাতির পিঠে চড়ে যেন রাজা চলেছেন রাজ্য দখল করতে। সিপাহী সেনাপতিদের সঙ্গে ডাইনোসার, বাঘ, ভাল্লুক, সিংহরাও যেন তার সঙ্গী। তাদের পায়ের নিচে পড়ে কাঁদছে সাধারণ মানুষ। রয়েছে ক্যাকটাস বাগান। কোথাও পাহাড়ের বুকে যেন লেগে আছে নানাবিধ সামুদ্রিক ফসিল। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে আসতেই ই সম্প্রদায়ের সংগীত মূর্ছনার সঙ্গে আমরা নেচে গেয়ে ক্লান্তি দূর করি। আর তার পাশেই সাজানো স্টোন ফরেস্টের নানান ফলমূল।

লেখক ও তার সঙ্গীরা

একসময় শেষ হয়ে আসে ঘণ্টা দুয়েকের এই পাথরের বনে পথচলা। কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর চলতে থাকে কি দেখলাম তা নিয়েই। সোফিয়া জানাতে থাকেন ২০০৭ সালেই ইউনেস্কো শিলিন পাথুরে বনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্যকেন্দ্র বলে ঘোষণা করেছে। আর স্টোন ফরেস্টের এ পাথরগুলোর সামনে প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্থানীয় আদিবাসীরা। স্টোন ফরেস্টের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আসীমার জন্য থাকে নানা আয়োজন। এছাড়াও প্রতি চান্দ্রবছরের ছয় নম্বর মাসের ২৪তম দিনে, ‘ই’ সম্প্রদায়ের মানুষরা পাথরের বনে মশাল উৎসব পালন করে। সেদিন এ বনে ‘ই’ সম্প্রদায়ের নানা ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের পসড়া বসে। মল্লযুদ্ধ, ষাঁড়ের লড়াই, বাঁশ বেয়ে ওঠা, ড্রাগন ড্রাগন খেলা, সিংহের নাচ, মুন ড্যান্স বা চান্দ্রনৃত্যের মতো ঐতিহ্যবাহী সব আয়োজনে জমজমাট হয়ে ওঠে এই পাথর বন।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন