নানজিং ট্র্যাজেডি: ইতিহাসের এক নির্মম হত্যাকান্ড

আইরীন নিয়াজী মান্না

বেড়াতে আমি ভীষণ পছন্দ করি। অফিসের কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে যাই নতুন কোন জায়গা দেখতে। বেড়ানোর জায়গাটি যদি হয় ঐতিহাসিক কোনো স্থান তাহলে তা আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় শত গুণ। বেড়ানোর পাশাপাশি ইতিহাসের অজানা অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়া যায় সরাসরি।

চাকরি সূত্রে চীনে বসবাস করেছি বেশ কয়েক বছর। এসময় বেইজিংয়ের ঐতিহাসিক সব জায়গাই প্রায় দেখা হয়ে গেছে। ঘুরেছি বেশ কয়েকটি প্রদেশ। বিশাল দেশ চীন। ২৩টি প্রদেশ তাদের। আমি ঘুরে দেখেছি ১৩/১৪টি মাত্র। চীনে একটি নিয়ম আছে, চীনা নতুন বর্ষ শুরু উপলক্ষে প্রতি বছর অক্টোবরে আটদিন সরকারি ছুটি থাকে। এ সময়টাতে দেশি-বিদেশীরা বেরিয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে, ঘুরতে। আমিও প্রতি বছর ওই লম্বা ছুটিতে চলে যেতাম নতুন কোনো শহরে। কিংবা চীনের বাইরে অন্য কোনো দেশে। ২০১৭ সালের কথা বলছি। সে বছর অক্টোবরের ছুটিতে আমার যাওয়ার কথা প্রতিবেশী রাষ্ট্র রাশিয়াতে। সব প্রায় ঠিকঠাক। এমন সময় আমার সহকর্মী শ্রীলঙ্কার মেয়ে পূর্ণিমা ভিরাসেকারা প্রস্তাব করলো চীনের প্রথম রাজধানী নানজিংয়ে ঘুরতে যাওয়ার।

চীনের জিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী নানজিং বা নানকিং। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং অপরূপ প্রকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা নানজিং শহর। চীনের দক্ষিণ অঞ্চলে জিয়াংসু প্রদেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক লজ্জাজনক অধ্যায় নানজিং ম্যাসাকার। জাপানি সৈন্যরা এসময় কতটা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল নানজিংবাসিদের তার এক হৃদয়বিদারক স্মৃতি আজও বহন করছে এই নগরী। মানুষের নৃশংসতার এক নগ্ন উদাহরণ এ গণহত্যা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে নানজিং ম্যাসাকারের একটি অদ্ভূত মিল আছে।

কি আর করা! পূর্ণিমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। দেশজুড়ে ছুটির কারণে ট্রেন, প্লেন বা বাসের টিকিট যেন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। অনেক কষ্ট করে ট্রেনের টিকিট মিললো বটে। তবে আমাদের দুজনকে যেতে হবে আলাদা আলাদা ট্রেনে। পূর্ণিমা চলে যাবে আগের দিন রাতের ট্রেনে। আর আমি যাবো পরের দিন ভোরের ট্রেনে। এছাড়া আর উপায় নেই। কি আর করা, অগত্যা আমাদের রাজি হতে হলো।

লেখক

বেইজিং থেকে নানজিং পৌঁছাতে দ্রুত ট্রেনে বা প্লেনে সময় লাগে পাঁচ ঘন্টা। ৯ অক্টোবর সকাল ১০টায় আমি পৌঁছে গেলাম নানজিং সাউথ স্টেশনে। সেখানে ভোর থেকেই পূর্ণিমা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। পূর্ণিমার সাথে দেখা হওয়ার পর আমরা যথারীতি চলে গেলাম হোটেলে। ফ্রেস হয়ে সামান্য খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম ঘুরতে। এ শহরে আমরা পাঁচদিন থাকবো। এ সময়ের মধ্যেই আমাদের অনেক কিছু দেখতে হবে, ঘুরতে হবে অনেক দর্শনীয় স্থান। আগে থেকেই একটি ছক করে রাখা হয়েছে।

নানজিং স্মৃতি জাদুঘর : প্রথম দিনই আমরা চলে গেলাম নানজিং স্মৃতি জাদুঘর দেখতে। আজ সে গল্পই বলবো। নানজিং স্মৃতি জাদুঘর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৭ সালে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজধানীর বুকে। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলোম জাদুঘরের গেটের সামনে। আমার চোখের সামনে এক নতুন বিশ্ব উন্মোচিত হলো।

নানজিং হত্যাকান্ড নিয়ে আমার আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। এ বিষয়ে কিছু পড়াশনাও করেছিলাম। যা এই শহরকে সামনে থেকে দেখার আগ্রহ তৈরি করে। তার পুরোটাই এ ভ্রমণে পুরিপূর্ণ হলো। ১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই জাপান পূর্ণ আগ্রাসন শুরু করে চীনে। যার ফলে একই বছর ১৩ আগস্ট তারা আক্রমণ চালায় শাংহাই শহরে। শাংহাই আক্রমণ প্রকৃত অর্থে নানজিং আক্রমণের প্রথম ধাপ। ১২ নভেম্বর শাংহাই জাপানি বাহিনীর আয়ত্তে চলে এলে তারা তিন দিক থেকে আক্রমণ করে নানজিংকে। ১৩ ডিসেম্বর নানজিং তাদের দখলে চলে আসে। এরপর জাপানী সেনারা আন্তর্জাতিক সব নিয়ম ভঙ্গ করে চীনা বাহিনী এবং নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এই নির্মম ঘটনা ইতিহাসে ‘নানজিং ম্যাসাকার’ বা ‘নানজিং ধষর্ণ’ নামে পরিচিত।

স্মৃতিসৌধ

ছয় সপ্তাহব্যাপী চলমান নানজিং ম্যাসাকারে প্রাণ হারায় তিন লাখ মানুষ। ধসে পড়ে শহরের এক-তৃতীয়াংশ ভবন। আর ধর্ষণের শিকার হয় ২০ হাজার নারী। কারো কারো মতে, ধর্ষণ করা হয় বিশ থেকে আশি হাজার নারী-শিশু ও কিশোরীকে। গণধর্ষণের শিকার হয় অসংখ্য নারী। নিমর্মভাবে হত্যা করা হয় হাজার হাজার শিশুকে। ছয় সপ্তাহ বা দেড় মাস স্থায়ী এই ম্যাসাকারে প্রতি ১২ সেকেন্ডে ঝরে পড়ে একেকটি তাজা প্রাণ। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে জাপানী সেনারা পঙ্গপালের মত প্রবেশ করে চীনের প্রাচীন নগরী নানজিং শহরে। এ সময় জাপানী হেড কোয়াটার থেকে নানজিং দখল করে নেয়ার আদেশ দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ ডিসেম্বর জাপানী সৈন্যরা নানজিং দখল করে নেয়। তাদের আদেশ দেওয়া ছিল: ‘কোনও যুদ্ধবন্দী গ্রহণ করা হবে না’। তার মানে হত্যা করতে হবে সবাইকে! এ যেন এক অলিখিত নির্দেশ। জাপানী সেনারা শুধু মাত্র লুট করে, জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ধ্বংস করেই খান্ত হয়নি। নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড চালায় চীনের অসহায় নাগরিকদের উপর। মৃত্যুর হলিখেলায় মেতে ওঠে তারা। দেড় মাসে পুরো নানজিং শহরকে পরিণত করে এক ভূতুরে মৃত্যু উপত্যকায়।

 

বন্দী চীনা সৈন্যদের হত্যা : জাপানিরা নানজিং দখল করে নিলে প্রায় নব্বই হাজার চীনা সৈন্য জাপানীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। জাপানী হেড কোয়াটার থেকে বলা হয়, কোনও যুদ্ধবন্দী গ্রহণ না করার জন্য। ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলোতে চীনা সৈন্যদের মনে ভয় সৃষ্টির জন্য জাপান কর্তৃপক্ষ বন্দী সকল চীনা সৈন্যকে হত্যার আদেশ দেয়। ট্রাকে করে চীনা সৈন্যদের নিয়ে যাওয়া হয় নানকিং শহরের বাইরে। সাহস বাড়ানোর জন্য কিংবা অমানুষিকতা প্রকাশ করার জন্য জুনিয়র বা নতুন জাপানী সৈন্যদের দিয়ে হত্যা করা হয় প্রায় নব্বই হাজার চীনা সৈন্যকে। জাপানী সৈন্যদের বলা হয় যত বেশি সম্ভব কষ্ট দিয়ে চীনা সৈন্যদের হত্যা করতে হবে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে, ধারালো তলোয়ার দিয়ে শিরচ্ছেদ করে, আগুনে পুড়িয়ে, জীবন্ত কবর দিয়ে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয় প্রায় নব্বই হাজার সেনা সদস্যকে। কে কত চীনা হত্যা করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে জাপানী সৈন্যদের মধ্যে। পঞ্চাশ থেকে একশ, একশ থেকে দেড়শ-এভাবে হত্যা করতে পারলে সৈনিকদের পদন্নতিসহ বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়। নিজের যোগ্যতা প্রমানের জন্য এ নির্মম হত্যার খেলায় মেতে ওঠে নিষ্ঠুর জাপনীরা।

জেনোসাইড বা গণহত্যা : নানজিং শহরে প্রবেশের পর চীনাদের গণহারে ভয়ংকরভাবে হত্যা করা শুরু করে জাপানীরা। শহরের যে কোনো স্থানে চীনাদের দেখা মাত্রই গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, ছুরি দিয়ে জবাই করে, তলোয়ার দিয়ে শিরচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়।নানজিংয়ের কোনো কোনো এলাকায় সাধারণ চীনাদের একটি বাড়িতে ঢুকিয়ে সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় তাদের। অনেককে উঁচু ভবন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয় নিচে। শিশুদের দু’পা ধরে চিরে ফেলে জাপানী বর্বর সৈন্যরা। গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য চীনাকে। ক্রমেই যেন লাশের পাহাড় গড়ে ওঠে সারা শহরজুড়ে। তাই নানজিংয়ের চারপাশে চীনাদের দিয়ে বিশাল গর্ত খোঁড়ানো হয়। চীনাদের মৃতদেহগুলো সেই গর্তগুলোতে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়। নানজিংয়ের গণহত্যা এত বেশি আকারে ছিল যে, এক সময় শহরের প্রতিটি জায়গা, রাস্তা, মাঠ ভাগ্যহত চীনাদের লাশে লাশে ভরে ওঠে। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর হতে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চলে এই নির্মম হতাকান্ড।

ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন দাসত্ব : চীনা সৈন্যদের হত্যা করার পর নিরীহ নানজিংবাসীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপানীরা। পাঁচ-ছয় বছরের ছোট মেয়ে শিশু হতে শুরু করে সত্তরোর্ধ্ব বয়স্ক নারীদের গণধষর্ণ করে তারা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ থেকে আশি হাজার শিশু-নারী-বৃদ্ধাকে গণধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের পর প্রায় সব ভিক্টিমকে উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। কাউকে কাউকে বেয়নেট, ছুরি, তলোয়ার দিয়ে যৌনিতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে জাপানী সৈন্যরা। এমনকি গর্ভবর্তী নারীদের প্রতিও কোনো দয়া করা হয়নি। গর্ভবতী চীনা নারীদের গণধর্ষণের পর ছুরি বা বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। ধর্ষণ করার সময় পরিবারের সদস্যদের বাধ্য করা হয় সে দৃশ্য দেখতে।

বিভৎসতার কিছু চিত্র

বেঁচে থাকা অবশিষ্ট নানকিং নারীদের জন্য আরো ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছিলো। জাপানী সৈন্যদের দখলকৃত জনপদের নারীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার প্রথা ছিল। এর ফলে চীনা অসংখ্য তরুণীকে যৌনদাসী হিসেবে ধর্ষিত হতে হয়েছে প্রতিনিয়ত।চীনের নানজিং নরমাল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’র ইতিহাসবিদ জিং শেংহংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, চীনের সাবেক রাজধানীতে জাপানি সৈন্যদের পরিচালনায় এ ধরনের ৪০টি যৌনপল্লী ছিল। চীনের পূর্বাঞ্চলীয় নানজিং নগরীতে সাতটি ভবনের এই কমপ্লেক্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই শতাধিক নারীকে জোরপূর্বক জাপানি সৈন্যদের মনোরঞ্জনে বাধ্য করা হতো।

নিশ্চুপ আন্তর্জাতিক মহল : নানজিংয়ের গণহত্যার বিষয়টি কয়েকদিনের মধ্যেই সারা বিশ্বের পত্রিকাগুলোতে প্রথম পাতার খবরে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইর্য়ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, রিডার্স ডাইজেস্টে নানকিংয়ের খবর ছাপা হয়। ইউরোপ, যুক্তরাজ্যেও বিষয়টি নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি হয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এ ব্যাপারে প্রায় নীরব ভূমিকা পালন করে। এদিকে জাপানী পত্রিকাগুলোতে এ খবর প্রকাশ করা হয় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারা গণমাধ্যমে প্রকাশ করছিলো জাপান সাম্রাজ্যের নতুন অংশ সংযোজিত হয়েছে।

মানবতার জয় : বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষরা একদম নিশ্চুপ ছিলো। নানজিং জাপানীদের হস্তগত হবার পর প্রায় সকল বিদেশী নাগরিক নানজিং ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বিশ থেকে পঁচিশ জন পাশ্চাত্য ও আমেরিকান ডাক্তার, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, যাজক তখনও নানজিংয়ে থেকে গিয়েছিলেন। তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে নানজিংবাসীদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। নানজিংয়ে রেড ক্রসের পতাকা ব্যবহার করে প্রায় দশ কিলোমিটারের একটি আন্তর্জাতিক নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠা করেন তারা। এই নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন জার্মান ব্যবসায়ী ও নাজি পার্টির সদস্য জন রাব (John Rabe)।

জাপানিরা নানজিং দখল করার পর যে সব চীনা নানজিং ছেড়ে পালাতে পারেনি তাদের একটি অংশ ওই নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেয়। এরা সংখ্যায় ছিলো প্রায় তিন লাখ। আর যে সব নানজিংবাসী নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নিতে পারেনি, তারা প্রায় সবাই জাপানী সৈন্যদের বর্বরতার শিকার হয়। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী হতে নানজিংয়ের চীনাদের উপর জাপানী সৈন্যদের অত্যাচার কমতে থাকে। কারণ, যৌনদাসী এবং কাজ করার জন্য বন্দী চীনা ছাড়া হত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়ণ করার জন্য আর কোনো চীনা নানজিংয়ে অবশিষ্ট ছিল না।

যুদ্ধাপরাধ ও বিচার : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে অবশেষে ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পন করে। এরপর শুরু হয় নানজিং গণহত্যার বিচার। বিভিন্ন ওয়ার ক্রাইম ট্রাইবুনালে নানজিং গণহত্যার জন্য জাপানী প্রিন্স কোতোহিতো কানিন, প্রিন্স আসাকা, জাপানী পররাষ্টমন্ত্রী কোকি হিরাতো, জেনারেল হেইসুকে ইয়ানাগাওয়া, জেনারেল ইওয়ানে মাতসুই, জেনারেল ইয়াসুজি ওকামুরা, লেফট্যান্ট জেনারেল ইসামো চো, লেফট্যান্ট জেনারেল হাইসাও তানি, লেফট্যান্ট জেনারেল কেসাগো নাকাজিমা, ক্যাপ্টেন গানকিচি তানাকা, সেকেন্ড লেফট্যান্ট তোশিয়াকি মুকাই, সেকেন্ড লেফট্যান্ট তশোয়োশী নোডাকে অভিযুক্ত করা হয়।

১৯৪৭ সালের ১০ মার্চে ফায়ারিং স্কোয়াডে লেফট্যান্ট জেনারেল হাইসাও তানির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাপানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোকি হিরাতো ও জেনারেল ইওয়ানে মাতসুইয়ের সুগামো কারাগারে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। প্রায় একশ জাপানী সামরিক অফিসার, সৈন্য, কর্মকর্তা-কর্মচারিকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়। জাপানী রাজ পরিবারের অভিযুক্ত কিছু সদস্য এবং কিছু উচ্চ পদস্থ জাপানী কর্মকর্তা চীনা ও পশ্চিমা কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তির আশ্রয় ও প্রতিরক্ষার কারণে বিচারদন্ড থেকে রক্ষা পায়।

শেষ কথা : সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের জন্য কোটি কোটি মানুষকে বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে। নানজিং গণহত্যাও এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। নানজিং গণহত্যা পৃথিবীর মনুষ্য নির্যাতনের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বর-নিমর্ম-নৃশংস ঘটনাগুলোর একটি।

সম্প্রতি জাতিসংঘ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বেইজিংয়ের অনুরোধে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই বিলটি অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৩৭ সালে নানজিংয়ের এ ঘটনা বিশ্ব রেকর্ডবুকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চীন বহুদিন ধরে আবেদন জানিয়ে আসছিল। ঐ ঘটনাকে একটি ব্যতিক্রমী ও স্পর্শকাতর ‘নানজিং ধর্ষণ’ হিসেবে উল্লেখ করায় প্রায়শই চীন ও জাপানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ঐ নির্মম, লোমহর্ষক ও পাশবিক ঘটনার আজ পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠু মীমাংসা করতে ব্যর্থ হওয়ায় চীন কর্তৃপক্ষ জাপানকে বরাোর দোষারোপ করে আসছিল।

৪০টি দেশের অনুমোদন সাপেক্ষে বিশেষজ্ঞদের বিশদ গবেষণা ও পরামর্শে দু’বছর প্রচেষ্টার পর সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমীরাতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ঐ বৈঠকে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়।

 

লেখক পরিচিতি: আইরীন নিয়াজী মান্না, সম্পাদক-উইমেননিউজ২৪.কম। সাবেক ফরেন এক্সপার্ট, চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই), বেইজিং, চীন।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন