দ্য লন্ডন আই: আধুনিক ব্রিটেনের মাইল ফলক

শোয়ায়েব চমক

পুরনো লন্ডনের ঐতিহ্য যেমন টাওয়ার ব্রিজ, তেমনি আধুনিক লন্ডনের আইকন হল লন্ডন আই। লন্ডন বেড়াতে এসে লন্ডন আই তে চড়েননি এমন পর্যটক খুঁজে পাওয়া যাবে না। লন্ডন আইতে না চড়া মানে লন্ডন বেড়ানোতে অপূর্ণতা থেকে যাওয়া। এই শহরে যে কয়টা গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় আধুনিক স্থাপত্য তৈরি হয়েছে তার মধ্যে লন্ডন আই অন্যতম।

ডেভিড মার্ক্স ও জুলিয়া বারফিল্ড হচ্ছেন আর্কিটেক্ট দম্পতি। এই দুজনের স্বপ্নের ফসল হচ্ছে এই লন্ডন আই। অর্থাৎ এই দুজনই লন্ডন আই এর মুল ডিজাইনার। সারা পৃথিবী যখন নতুন মিলিনিয়ামে প্রবেশ করছে তখন এই দুজন দম্পতি লন্ডন আইএর ডিজাইন করেন। তাদের চোখে এই চাকা হচ্ছে সময়ের চাকা। এই চাকা ঘুরিয়েই নতুন মিলিনিয়ামে প্রবেশ করবে লন্ডন ‼ সেই লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে সেন্ট্রাল লন্ডনের ওয়েস্ট মিন্সটার এলাকায় সাউথ ব্যাঙ্কে বিগ বেন এর অপর পাশে লন্ডন আই এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৯৯ এর অক্টোবরে টেমস নদী ব্যবহার করে লন্ডন আই এর চাকাটি সাউথ ব্যাঙ্কে আনা হয় এবং মার্চ ২০০০ এ প্রথম এটি জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

১৩৫ মিটার উঁচু এই চাকাটি জাপানের ইয়োকোহামা বে তে অবস্থিত চাকার থেকে ৩০ মিটার বড়। এর আগে ইয়োকোহামা বে এর চাকাটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উচু চাকা। আধুনিক লন্ডনের এই মাইল ফলক দ্য লন্ডন আই প্রতিদিন গড়ে ১৫০০০ পর্যটক বহন করে। এই চাকায় সর্বমোট ৩২ টি ক্যাপসুল আছে। এই ক্যাপসুল গুলোতে চড়ে পর্যটকরা লন্ডন আই উপভোগ করেন।

নির্মাণের শুরু থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল দ্য মিলিনিয়াম হুইল। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দ্য লন্ডন আই। শুরু থেকে ব্রিটিশ এয়ারয়েজ ছিল এর মুল অর্থ দাতা। পরবর্তীতে মার্ক বারফিল্ড আর্কিটেক্ট ও দ্য তুস্যদস গ্রুপ ২০০৫ পর্যন্ত শেয়ার হোল্ডার হিসাবে কাজ করে। বর্তমানে দ্য লন্ডন আই কোম্পানি লিমিটেড ও মারলিন এন্টারটেইনমেন্ট গ্রুপ এটি পরিচালনা করছে। এটি নির্মাণ করা ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশাল আকৃতির এই চাকা বর্তমানে বিশ্বের সবচাইতে উঁচু অবসারভেসন হুইল। ব্রিটিশ ডিজাইন, আর্কিটেকচার ও ইঞ্জিনিয়ারিঙের এ এক অনন্য উদাহরন।

রাতের লন্ডন আই

যাত্রী বহনকারী ক্যাপসুল গুলোর নকশা করা হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে যাতে পর্যবেক্ষকগণ অত্যন্ত সহজ ভাবে অনেক উঁচু থেকে লন্ডন শহরটিকে উপভোগ করতে পারেন। ক্যাপসুল গুলোকে চাকার বাহিরের দিকে এমন ভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে চাকা ঘোরার সাথে সাথে যাত্রীদের চোখের সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা না আসে। যার ফলে যখন একটি ক্যাপসুল চাকার সবচেয়ে উচুতে পৌঁছে যায় তখন ক্যাপসুলের ভেতরে থাকা পর্যবেক্ষকগণ ৩৬০ ডিগ্রীতে প্যানারমিক ভিউতে পুরো লন্ডন শহর উপভোগ করতে পারেন। এক একটি ক্যাপসুলের ওজন ১০ টন। এই ৩২ টি ক্যাপসুল বৃহত্তর লন্ডনের ৩২ টি উপশহর বা বরাহ এর প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি ক্যাপসুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং পর্যবেক্ষকদের বসার জন্য বেঞ্চ দেয়া আছে। সর্বোচ্চ ২৫ জন একটি ক্যাপ্সুলে আরোহন করতে পারে।

যেকোনো পর্যটকের কাছে এটা একটি বিস্ময় যে ১৩৫ মিটারের এই চাকাটি কিভাবে দাড়িয়ে আছে। অবাক হবার বিষয় হল মাত্র ৬ টি শক্তিশালী ক্যাবল এই বিশাল আকৃতির চাকাটিকে মূল বেস এর সাথে আটকে রেখেছে। এছাড়া চাকাটিতে ১৬ রিম রোটেশন ক্যাবল আছে এবং ৬৪ টি স্পোক ক্যাবল আছে। যে কারনে এটাকে বিশাল আকৃতির সাইকেলের চাকার মতো দেখায়।  চাকাটির মূল বেসটি তৈরি হয়েছে ইংরেজি অক্ষর A এর আদলে। এই বেস দাঁড় করাতে লেগেছে ২২০০ টন কংক্রিট এবং ৪৪ টি কংক্রিটের পাইল। প্রতিটি কংক্রিটের পাইল সমতল থেকে ৩৩ মিটার গভীর। চাকাটিকে ধরে রাখার যে টেনশন ফাউন্ডেশন যে ৬ টি শক্তিশালী ক্যাবল রয়েছে সেগুলো মাটির সাথে আটকাতে লেগেছে ১২০০ টন কংক্রিট।

চাকাটির মধ্যে রয়েছে একটা শক্তিশালী স্পাইন্ডল। যা কিনা চাকার ৬৪ টি স্পোক কে একসাথে আটকে রেখেছে। এই স্পাইন্ডল টি ঘোরার ফলেই পুরো চাকাটি ঘোরে। এটি তৈরি হয়েছে ইস্পাত দিয়ে। বিখ্যাত স্কোডা স্টিল এই স্পাইন্ডল তৈরি করেছে। প্রতি বছর গড়ে ৩.৫ মিলিয়ন পর্যটক লন্ডন আইতে ভ্রমন করে থাকেন। এক রাউন্ডে গড়ে ৮০০ পর্যটক এতে আরহন করেন। এক রাউন্ড ভ্রমনে সময় লাগে ৩০ মিনিট। সাধারন মানুষ এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ২০০২ সাল থেকে ওয়েডিং প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, যার অধীনে যে কেউ চাইলে বিয়ে করার জন্য একটি ক্যাপসুল ভাড়া করতে পারে। এ পর্যন্ত অনেক দম্পতি লন্ডন আই এর ক্যাপসুল ভাড়া করে বিয়ে করেছে। পর্যটনের দিক থেকে আকর্ষণীয় হবার কারনে লন্ডন আই প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার জিতেছে। এর মধ্যে বিবিসি লন্ডন পিপলস চয়েস এ্যাওয়ার্ড, বেষ্ট মিলিনিয়াম এট্রাকশন এ্যাওয়ার্ড, কুইন্স এ্যাওয়ার্ড ফর এন্টারপ্রাইজ, দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এ্যাওয়ার্ড, দ্য ব্রিটিশ ট্রাভেল এ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি রয়েছে।

এত সাফল্যের পরেও কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। লন্ডন আই যে জায়গায় রয়েছে সেই জমির মালিক সাউথ ব্যাঙ্ক সেন্টার। ২০০৫ সালে তারা এই জমির ভাড়া ১৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এতদিন লন্ডন আই কর্তৃপক্ষ সাউথ ব্যাঙ্ক সেন্টার কে বছরে ৬৫০০০ পাউন্ড ভাড়া দিত, এখন সেটি বেড়ে দাড়িয়েছে ১ মিলিয়ন পাউন্ড। লন্ডন আই কর্তৃপক্ষ যদি রাজি না হয় তাহলে লন্ডন আই এর চাকা থেমে যেতে পারত। কিন্তু চাকা থেমে থাকেনি। চাকা এখনও চলছে। তবে এই চাকায় আরোহণ করার মূল্য অর্থাৎ টিকেটের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সর্বনিম্ন টিকেটের দাম ২০ পাউন্ড ও সর্বোচ্চ ৩১ পাউন্ড।

ব্রিটিশ স্থ্যাপত্বের এক অনন্য নিদর্শন লন্ডন আই পর্যটকদের  কাছে অনেক আকর্ষণীয় বিষয়। হলিউড ও বলিউদের অনেক সিনেমায় এই লন্ডন আই এর ব্যবহার হয়েছে। সারা পৃথিবী থেকে অসংখ্য মানুষ প্রতি বছর লন্ডন বেড়াতে আসেন। বেড়াবার অনেক জায়গার মধ্যে অন্যতম এই লন্ডন আই। আপনিও আমন্ত্রিত ‼    

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন