আরিফুল রাজীব
ঘড়ির কাটা রাত সাড়ে ৯টা ছুঁই ছুঁই। দাঁড়িয়ে আছি কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের ২ নং প্লাটফর্মে। অপেক্ষা চিটাগং মেইলের। মাথায় চিন্তা একটাই ট্রেন প্লাটফর্মে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নিজের আসন ধরতে হবে। না পারলে বিপদ। কারণ, এই ট্রেনের টিকেটে নির্ধারিত কোন সিট নাম্বার নেই। যেমনটা ভাবা। ট্রেন প্লাটফর্মে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পড়িমরি করে ট্রেনে ঢুকে পড়লাম। কথা মত আসনও পেয়ে গেলাম। সাড়ে ১০টায় সাইরেন বাজিয়ে ব্যস্ত নগরীকে বিদায় জানিয়ে আমরা চললাম চট্টগ্রামের পথে। রাতের আধাঁর ভেদ করে ছুটে চলছে ট্রেন, আমাদের গন্তব্য সীতাকুণ্ড। পরদিন সকাল ৭টায় কুয়াশা ভেজা সীতাকুণ্ড ষ্টেশনে নামলাম। সীতাকুণ্ড বাজারে নাস্তা সেরে সিএনজি যোগে আমরা সরাসরি চলে যাই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে। এখান থেকেই শুরু হবে আমাদের অভিযান। চন্দ্রনাথ চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। এটি সীতাকুণ্ড পাহাড় নামেও পরিচিত। উচ্চতা প্রায় ১,০২০ফুট। এর শৃঙ্গেই চন্দ্রনাথ মন্দিরের অবস্থান। পাহাড়টি হিন্দু ধর্মলাম্বীদের তীর্থস্থান। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে সীতা দেবীর দক্ষিণ হস্ত এখানে পতিত হয়েছিল।
সকাল ৮টা নাগাদ আমাদের অভিযান শুরু হল। প্রথমে পাকা রাস্তা ধরে ট্রেকিং শুরু হল। রাস্তা একটু একটু করে উপরের দিকে উঠে গেছে। রাস্তা ধরে অল্প একটু উঠতেই চোখে পড়লো হাতের ডানে পাহাড়ের নিচে সীতা মন্দির। আর একটু উপড়ে উঠতেই পেলাম বড় মন্দির। এবার মন্দির থেকে কাঁচা মাটির উঁচু নিচু আকাবাকা পথ ধরে উপরের দিকে এগোতেই ছোট একটি ঝর্ণা চোখে পড়ল। এখান থেকে রাস্তা দুই ভাগ হয়ে খাড়া পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে। দুটি পথ দিয়েই পাহাড়ের চুড়ায় ওঠা যায়। ডানের পথটি কংক্রিটের সিঁড়ি আর বামের পথটির কিছু অংশ সিঁড়ি এবং মাটির রাস্তা। সিঁড়ির চেয়ে মাটির রাস্তা ধরে ওঠা সহজ বলে আমারা বামের রাস্তাটাই বেছে নিলাম। কুয়াশা কেটে আকাশ ঝলমল করছে। খড়খড়ে শুকনো পাহাড়। সূর্যের তাপ বেশি না হলেও বেশ পোড়াচ্ছিল। এমনি খড়খড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতেই পেলাম বিরূপাক্ষ মন্দির। এই মন্দিরটি চন্দ্রনাথ চূড়া থেকে বেশ কিছুটা নিচে অবস্থিত। এখানে রয়েছে দুটি মন্দির। রয়েছে পুরাতন বট গাছ। গাছের গায়ে সনাতন ধর্ম অবলম্বীরা মনের আশা পুরণের আশায় লাল সুতা বেধে রেখেছে। বটবৃক্ষের নিচে আমরা বিশ্রাম নিলাম। কারণ এখনো ঢের পথ বাকি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চূড়ার টানে আমরা আবার চলা শুরু করলাম।
ক্লান্ত শরীর, তৃষ্ণার্ত আমরা, দাঁড়িয়ে আছি সমুদ্র পৃষ্ট থেকে হাজার ফুট উচ্চতায়। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির। পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি। মন্দিরের পাশের টং দোকান থেকে পানি কিনে পাহাড়ের নিচে তাকালাম। প্রথমেই চোখে পড়লো বিরূপাক্ষ মন্দির। নিচে নয়ন জুড়ানো জমাট বাধা সবুজের আচ্ছাদন। আমার কাছে চন্দ্রনাথের চূড়া থেকে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে বিরূপাক্ষ মন্দির। পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট একটি মন্দির। মাথায় নিশান আর আঁকাবাকা মেঠো পথ উঠে এসেছে পাহাড় চূড়ায়।
এবার আমাদের নামতে হবে। যেহেতু আমরা উঠেছি কাঁচা মাটির পথ ধরে তাই ঠিক করলাম নামব সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ি দিয়ে একটু নামতেই কিছুটা সমতল জায়গার ওপর বিশাল বট বৃক্ষের দেখা পেলাম। বৃক্ষের ছায়া তলে প্রাণ জুড়ানো শীতল হিম হিম বাতাস। এমন বাতাসে সবুজ ঘাসের চাদরে শুয়ে গতকালের নির্ঘুম রজনীর ক্লান্তি দূর করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। আহা শান্তির ঘুম! না পাঁচ তারকা হোটেলের নরম বিছানায় এমন ঘুম সম্ভব নয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ মনে পড়ল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। এই সীতাকুণ্ডে বহু বছর আগে তিনি এসেছিলেন। এর অপরুপ সৌন্দর্য্য অবলোকন করে মুগ্ধ হয়ে নজরুল বলেছিলেন ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়-ঐ’।