ঘোর লাগানো দিল্লি ভ্রমণ

ট্রাভেলগবিডি ডেস্ক

দিল্লি বহু দূর। তৎকালীন বঙ্গ বা বাংলা থেকে ভারতের বর্তমান রাজধানী দিল্লির দূরত্ব বোঝাতেই এই প্রবাদ বাক্যটির উৎপত্তি। কিন্তু কালে কালে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পৃথিবী যতটা এগিয়েছে দিল্লির দূরত্ব ঠিক ততটাই কমে এসেছে। বর্তমানে যে কেউ হাজার বিশেক টাকা খরচ করলে মাত্র আড়াই ঘন্টায় দিল্লি পৌছাতে পারে। সুতরাং দিল্লি আর বহু দূরে নয়। মুঘল আমল থেকেই দিল্লি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই শহরের অলি-গলিতে আছে ঐতিহাসিক সব জায়গা আর স্থাপনা। এই সব ঐতিহাসিক নিদর্শন সবসময় পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই প্রতি বছর বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ পর্যটক ছুটে যায় দিল্লি দর্শনে। তবে এই শহরে প্রথমবার যেয়ে যে কারোরই ঘোর লেগে যায়। কারণ গোটা দিল্লি জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। ফলে মনোভাব হয়ে দাড়ায়, কোনটা রেখে কোনটা দেখি ? এই ঘোর কাটাতে ট্রাভেলগবিডির পাঠকদের জন্য দিল্লির সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা গুলোর বর্ণনা তুলে ধরা হল।

ইন্ডিয়া গেট: 

 ইন্ডিয়া গেট 

ইন্ডিয়া গেট দেখার মাধ্যমে আপনার দিল্লি দর্শন শুরু করতে পারেন। আপনি শহরের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, অটো বা উবার কিংবা মেট্রোতে করে ইন্ডিয়া গেটে পৌছাতে পারবেন। তাছাড়া এয়ারপোর্ট থেকেও ইন্ডিয়া গেটের দুরত্ব বেশি নয়। সুতরাং আপনি এয়ারপোর্টের আশে পাশের কোন হোটেলে থাকলে সহজেই ইন্ডিয়া গেট ঘুরে আসতে পারবেন। তবে আপনি যদি ট্রেনে দিল্লি করে যান সেক্ষেত্রে ইন্ডিয়া গেটকে আরও হাতের নাগালে পাবেন। দিল্লি ট্রেন স্টেশন থেকে ইন্ডিয়া গেটের দুরত্ব মাত্র সাড়ে ৪ কিলোমিটার। ইন্ডিয়া গেট মূলত একটি স্মৃতিস্তম্ভ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭০ হাজার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনার স্মরণে এটি বানানো হয়। এখানে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ নামক একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে। ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ বানানো হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের স্মরণে। যুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার একটি জাদুঘরও আছে এখানে।

 

রাষ্ট্রপতি ভবন

রাষ্ট্রপতি ভবন

ইন্ডিয়া গেট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের দূরত্ব মাত্র ৫ কিমি.। ইন্ডিয়া গেট থেকে সোজা তাকালেই চোখে পড়ে ভবনটি। রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবন দেখার মতো এক স্থাপনা। এর কিছু অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা। তবে সেখানে প্রবেশের জন্য আগে থেকেই অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়। প্রবেশের দিন বৃহস্পতিবার থেকে রোববার। সময়সীমা সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। রাষ্ট্রপতি ভবনের কাছেই ভারতের পার্লামেন্ট ভবন। সেটি অবশ্য বাইরে থেকেই দেখতে হয়। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। ইন্ডিয়া গেট থেকে ট্যাক্সিতে করে রাইসিনা হিলসে যাওয়া যায়। ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ রুপির মতো।

জামা মসজিদ

জামা মসজিদ

রাইসিনা হিলস থেকে বের হয়ে চলে যেতে পারেন পুরোনো দিল্লি জামা মসজিদে। দুরত্ব সাড়ে সাত কিলোমিটারের মতো। বাস,ট্যাক্সি কিংবা উবারে করে যাওয়া যায়। বাসে খরচ পড়ে ৭০ রুপির মতো, ট্যাক্সিতে ১৪০ থেকে ২০০ রুপির মতে। ঘন্টা খানিক সময় ব্যয় করে হেটেও যাওয়া যায়। পুরনো দিল্লির ঘিঞ্জির মধ্যে সুবিশাল এই মসজিদ দেখে আপনি অবাক হবেন। এটি গোটা ভারতের তো বটেই পৃথিবীর অন্যতম বড় মসজিদ। এখানে মসজিদের ভিতর বাহির মিলিয়ে প্রায় ৮৫ হাজার লোক একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে।  লাল বেলেপাথর ও সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি এই মসজিদটি ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুঘল সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করেছিলেন। কথিত আছে এই মসজিদ নির্মাণে তৎকালীন সময়ের এক মিলিয়ন রুপি ব্যয় হয়েছিল।

লাল কেল্লা

লাল কেল্লা

জামা মসজিদ থেকে হাটা দুরত্বে অবস্থিত মুঘল আমলের বিখ্যাত দুর্গ লাল কেল্লা বা রেড ফোর্ট। ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহান এটি নির্মাণ করেন। তাজমহলের অন্যতম স্থপতি আহমেদ লহরি ছিলেন এই কেল্লার নকশাকার। কেল্লার চারদিকে লাল বেলে পাথরের উচু প্রাচীর রয়েছে। প্রাচীরসহ কেল্লার রঙ লাল হওয়ার কারণেই এটি রেড ফোর্ট বা লাল কেল্লা নামে পরিচিত। দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, রংমহল, খাসমহল, মমতাজ মহল, হীরা মহল নামে বেশ কিছু ভাগে এই কেল্লা বিভাজিত। মুঘল আমলে কেল্লার প্রতিটি মহলই ছিল মনি-মুক্তা ভরা আর চাকচিক্যে ঠাসা। ব্রিটিশদের লুট করা বিশ্ববিখ্যাত হীরা কোহিনুর এই কেল্লাতেই সংরক্ষিত ছিল। তবে সবকিছু ছাপিয়ে নজর কাড়ে ‘নহর-ই-বেহেশত’ নামক একটি পানির ধারা। এটি পুরো কেল্লায় নির্বিঘ্নে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দিল্লির চরম গরমে কেল্লাবাসীকে শীতলতা উপহার দিত। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে মিয়ানমারে নির্বাসনের আগে এই কেল্লাতে বন্দি করে রাখা হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই কেল্লায় স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই থেকে ভারতের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসে এখানে দাঁড়িয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন।

লোটাস টেম্পল

লোটাস টেম্পল

পদ্ম ফুলের ন্যায় দেখতে এই উপাসনালয়টি মূলত বাহাই সম্প্রদায়ের। বাহাই ধর্ম বা বাহাই বিশ্বাস হচ্ছে বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী একটি ধর্ম বা বিশ্বাস। অত্যন্ত মনোরম এই উপাসনালয়টি বাহাই সম্প্রদায়ের হলেও এখানে যেকোনো ধর্মের বা বিশ্বাসের মানুষ গিয়ে নীরবে বসে প্রার্থনা করতে পারেন। ভেতরের অদ্ভুত নীরবতা আপনাকে অন্য রকম শান্তি দেবে। রেড ফোর্ট থেকে লোটাস টেম্পলের দূরত্ব পনেরো কিলোমিটারের কিছু বেশি। বাস, ট্যাক্সি কিংবা উবারে করে যাওয়া যায়। বাসে ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ রুপি, ট্যাক্সিতে ৩০০ থেকে ৩৫০ রুপির মতো খরচ হয়।

কুতুব মিনার

কুতুব মিনার

লোটাস টেম্পল থেকে কুতুব মিনারের দূরত্ব দশ কিলোমিটারের মতো। দিল্লির অন্যতম দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপনাটির নির্মাতা দ্বাদশ শতকের দিল্লির সুলতান কুুতুব উদ্দিন আইবেক। মিনারটির উচ্চতা ২৪০ ফুট। বাস ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ রুপি, ট্যাক্সিতে করে গেলে ২১০ থেকে ৩০০ রুপির মতো। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তার বড় পত্নী হাজি বেগম এই সমাধি নির্মাণ করেন। চারিদিকে বাগান ঘেরা এই সমাধিতে তাজমহলের স্থাপত্য ছাপ রয়েছে। তাজমহলের প্রধান স্থপতি ঈশা খার কবরও এই সমাধিতে। রাতের বেলা আলোকিত অবস্থায় এই সমাধিটি এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করে। কুতুব মিনার থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটারের মত। বাস,ট্যাক্সি এবং মেট্রো রেল করে এখানে যাওয়া যায়।

হুমায়ূন সমাধি

হুমায়ূন সমাধি

দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তার বড় পত্নী হাজি বেগম এই সমাধি নির্মাণ করেন। চারিদিকে বাগান ঘেরা এই সমাধিতে তাজমহলের স্থাপত্য ছাপ রয়েছে। তাজমহলের প্রধান স্থপতি ঈশা খার কবরও এই সমাধিতে। রাতের বেলা আলোকিত অবস্থায় এই সমাধিটি এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করে। কুতুব মিনার থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটারের মত। বাস,ট্যাক্সি এবং মেট্রো রেল করে এখানে যাওয়া যায়।

তাজমহল

তাজমহল

দিল্লি দর্শনের কথা বলতে গিয়ে আগ্রার তাজমহল দর্শনের কথা বলাটা অনেকের কাছে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো মনে হতে পারে। তবে দিল্লি গিয়ে তাজমহল না দেখে ফেরাটাও ভারী অন্যায় হয়ে যায়। কারণ দিল্লি থেকে তিন ঘন্টার দূরত্বে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন তাজমহলের অবস্থান। দিল্লি থেকে সকাল ৬টায় রওনা দিলে ১০টার মধ্যে তাজমহলে পৌছানো যায়। বাস, ট্রেন, ট্যাক্সিতে করে আগ্রায় যাওয়া যায়। তাজমহল দর্শন শেষে আগ্রাতে অবস্থিত আগ্রা ফোর্ট ও ফতেহপুর সিক্রি দেখতে যেতে পারেন।

আগ্রায় মুঘল শাসকেরা যে কেল্লায় থাকতেন, তা আগ্রা ফোর্ট নামে পরিচিত। এর স্থাপত্য শৈলীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দিল্লির রেড ফোর্ট বানানো হয়েছিল। এছাড়া আগ্রার অন্যতম বিস্ময় পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে মুঘল সম্রাট আকবরের বসতি ফতেহপুর সিক্রি। এসব স্থাপনা দর্শন শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাসকে আপনার কাছে জীবন্ত করে তুলবে।

খাওয়া-দাওয়া: 

দিল্লি শুধু ঘোরার নয় পেট পুরে খাওয়ার জন্যও বিখ্যাত। পুরনো দিল্লি আমাদের পুরনো ঢাকার মতোই বাহারি রসনার জন্য বিখ্যাত। পুরনো দিল্লির জামা মসজিদের পাশেই রয়েছে শতবর্ষী পূরাতন বিখ্যাত করিম’স হোটেল। এই হোটেলটি ১৯১৩ সাল থেকে সাধারণ মানুষের জন্য রাজকীয় মুঘলাই খাবার পরিবেশন করে আসছে। করিমের বিরিয়ানির পাশাপাশি কাবাব, মাংসের নানা পদ আর ক্ষীরের স্বাদও মুখে লেগে থাকার মতো। করির’স হোটেলের মতো পুরনো দিল্লিার অলিগলির দোকানেও পাবেন সুস্বাদু বিচিত্র সব খাবার।এছাড়া যারা স্ট্রিট ফুড পছন্দ করেন তারা কুতুব মিনার দর্শন শেষ করে চলে যেতে পারেন সরোজিনী মার্কেটে। এখানে পানিপুরি, পাউভাজি, দোসাসহ নানা সুস্বাদু খাবার খেতে পারবেন বেশ কম দামে। এছাড়া এই মার্কেট কম দামে ভালো জিনিস কেনার জন্য বিখ্যাত। সরোজিনী মার্কেটের পাশে দিল্লি হাটে পাবেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা জিনিস পাওয়া যায়। দামও হাতের নাগালে। যাতায়াত আকাশপথে ঢাকা থেকে দিল্লির দূরত্ব আড়াই ঘণ্টার মতো। জনপ্রতি যাওয়া-আসার খরচ ২০ হাজার টাকা। ট্রেনে করে গেলে খরচ অনেক কমে যাবে। ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে কলকাতা গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে করে দিল্লি যেতে পারেন। 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন