কলকাতায় গেলে যা মিস করবেন না (পর্ব-২)

দিবাকর

 

৮. নবীন চন্দ্র দাস (১৯৩৫)
আহা রসগোল্লার এমন স্বাদ বুঝি এখানেই মেলে। এর ঠিকানা: ৭৭, যতীন্দ্রমোহন অ্যাভেনিউ কলকাতা ৭০০ ০০৫ (শোভাবাজার) খোলা থাকে: সকাল ৭.৩০থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।

নবীনের রসগোল্লা

সেরা বলে যে খাবার বাছা হল: রসগোল্লা
বাগবাজারের নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লাকে বিশেষ স্বাদযুক্ত করে বাজারজাত করেন। যদিও তিনি প্রথমে সন্দেশ বানিয়েছিলেন। তারপর তৈরি করেন রসালো মন ভরানো রসগোল্লা। প্রথম প্রথম বাঙালি নবীন দাসের রসগোল্লাকে ভাল করে নেয়নি। একদিন ভগবান দাস বগলা নামে জনৈক ব্যবসায়ী গ্রীষ্মের দুপুরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাগবাজারের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে প্রচন্ড গরমে খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে তাঁর পুত্র। এমন সময় তিনি নবীন দাসের দোকান দেখতে পান। বগলার ছেলে তখন এতই তৃষ্ণার্ত যে চলার শক্তিও তার ছিল না। বাধ্য হয়ে বগলা দোকানদারের কাছে এক গ্লাস জল চাইলেন।

দোকানি ছেলেটিকে জলের সঙ্গে একটি রসগোল্লাও খেতে দেন। শিশুটির সে মিষ্টির স্বাদ দারুণ লাগে। ছেলের খুশি দেখে বাবাও খেয়ে ফেলেন একখানা রসগোল্লা। তার পর আরও একটা। রসগোল্লার অপূর্ব স্বাদে মুগ্ধ হয়ে পিতা-পুত্র মিলে পেটভরে খেলেন মিষ্টি। বগলা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ মিষ্টির অর্ডারও দিয়ে দিলেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি নবীন দাসকে। দেখতে দেখতে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেল তাঁর রসগোল্লার খ্যাতি। ‘বাগবাজারের নবীন দাস’ হয়ে উঠলেন ‘রসগোল্লার কলম্বাস’।

 

৯. কে সি দাস (১৯৩৫)
রসগোল্লার অঅরেক কিংবদন্তি। এর ঠিকানা: ১১ এ এবং বি, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, কলকাতা ৭০০ ০৬৯ (ধর্মতলার মোড়ের কাছে) খোলা থাকে: সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।

কেসি দাসের রসগোল্লা

সেরা বলে যে খাবার বাছা হল: রসগোল্লা
নবীন দাসের ছেলে কে সি দাস ও নাতি সারদাচরণ দাস মিলে ধর্মতলায় একটি বড়সড় মিষ্টির দোকান চালু করেন। তাঁদের চেষ্টাতেই রসগোল্লার আর একটি নতুন সংস্করণ বাজারে এলো রসমালাই। কে সি দাসের কথা উঠবে আর ‘রসগোল্লা’র আবিষ্কর্তা তাঁদের বাবা নবীন চন্দ্র দাসের কথা উঠবে না, তাও কি হয়? রসগোল্লার সেই সনাতন স্বাদ দিব্যি বহাল রেখেছে এই দোকান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রসগোল্লার রকমফের ঘটেছে। যেমন, স্ট্রবেরি রসগোল্লা। এ ছাড়াও এদের নলেনগুড়ের সন্দেশ, নলেরগুড়ের রোল, ল্যাংচা না খেলে কলকাতার মিষ্টির স্বাদ অধরা থেকে যাবে। শীতের স্পেশালিটি গুড় রায়টাকলি, গুড়ের শঙ্খ, গুড়ের তালশাঁস, অমৃতকুম্ভ।

 

১০. মোকাম্বো (১৯৪১)
খাবারের বৈচিত্র্য আনতে এদের জুড়ি নেই। এর ঠিকানা: ২৫বি, পার্ক স্ট্রিট, গ্রাউন্ড ফ্লোর, কলকাতা ৭০০ ০১৬ (ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ও পার্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থলের কাছে) খোলা থাকে: বেলা ১১.১৫ ৯টা থেকে রাত ১১.১৫ পর্যন্ত।

মোকাম্বা ও কন্টিনেন্টাল

সেরা বলে যে খাবার বাছা হল: কন্টিনেন্টাল
ইউরোপের রেস্টুরেন্টগুলো সেরা হয় কারণ, তাদের পরিচালকেরা খুঁতখুঁতে হন এবং সঠিক পথে ব্যবসা করার দিকে জোর দেন। এই বিশ্বাস থেকে মোকাম্বোর প্রথম শেফ-কাম-ম্যানেজার ছিলেন অ্যান্টোনিও প্রানধে। তিনি ইটালির মানুষ। আর তাই গোড়া থেকেই এই রেঁস্তোরার খাদ্য তালিকায় ইউরোপিয়ান ও ইটালিয়ান খাবারের আধিক্য ছিল। যেমন, চিকেন সিসিলিয়ান, ক্যানেলোনি কিংবা আও গ্র্যাটিন। আ লা কিয়েভ ও চিকেন স্ট্রোগানফ তো রাশিয়ান খাবার। মি. প্রানধে এই রেস্টুরেন্টের প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন। শুরুর সময় এখানে লাইভ মিউজিক ও ডান্স ফ্লোরের ব্যবস্থা ছিল। মনে রাখতে হবে, তখনও ইউরোপে ডিসকো থেক চালু হয়নি। এখন আধুনিক ব্যবস্থায় এখানে মিউজিকের আসর বসে।

 

১১. সিরাজ (১৯৪১)
বিরিয়ানি প্রসিদ্ধ দোকান সিরাজ। এর ঠিকানা: ১৩৫, পার্ক স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০১৪ (মলি­ক বাজার ক্রসিং-এ নিউরোসায়েন্স হসপিটালের পাশে) খোলা থাকে: বেলা ১২ থেকে রাত ১১.১৫ পর্যন্ত।

সিরাজের বিরিয়ানি

সেরা বলে যে খাবার বাছা হল: বিরিয়ানি
বিরিয়ানি ভালবাসেন না এমন খাদ্যরসিকের সন্ধান পাওয়াই দুষ্কর। জিভে জল আনা যে সব মুঘল খাবার রসনাতৃপ্তির অভিধানে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকে, তার মধ্যে বিরিয়ানি অন্যতম। তবে কলকাতার বিরিয়ানির লখনৌ বা হায়দরাবাদি বিরিয়ানি থেকে কিছুটা আলাদা। বহু বিরিয়ানি রসিকের মতে সিরাজের বিরিয়ানিই সেরা- তা চিকেন হোক বা মাটন। তুলতুলে মাংসের টুকরো আর সুসিদ্ধ আলু দিয়ে তৈরি এই বিরিয়ানির স্বাদ জিভে লেগে থাকে। মোগলাই খানা পরিবেশনের উদ্দেশে ১৯৪১ সালে বিহার থেকে কলকাতায় আসেন মহম্মদ আরশাদ আলি এবং মহম্মদ হুসেন। এখানে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের খাস বাবুর্চির বংশধর মহম্মদ সামসুদ্দিনের সঙ্গে। এই তিন জন মিলে বানিয়ে ফেলেন সিরাজ রেস্তোরাঁ। ১৯৫৬ সালে পাকাপাকিভাবে রেস্তোরাঁর নাম হয় সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁ। কলকাতায় আসা বহু সেলেবের প্রথম পছন্দ সিরাজের বিরায়ানি। এদের খদ্দের তালিকা তাই বেশ বিখ্যাত। আর ডি বর্মন, ফারুক শেখ, আমজাদ খান, মকবুল ফিদা হুসেন থেকে শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, মহেন্দ্র সিং ধোনি, সাবা করিম, শোয়েব আখতার, রণবীর কাপুর, আশিস বিদ্যার্থী, বিপাশা বসু, সুস্মিতা সেন সকলেই সিরাজে ঢুঁ মেরেছেন বা মারেন। শোভা দে তো সিরাজের বিষয়ে টুইট অবধি করেছেন।

 

১২. ইন্ডিয়ান কফি হাউস (১৯৪২)
কলেঝ স্ট্রিটের কফি হাউজ একবার যাননি এমন ভ্রামণিক খুঁজে পাওয়া বিরল হবে বোধকরি। এর ঠিকানা: ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০১৪ (কলেজ স্ট্রিট প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির বিপরীতে) খোলা থাকে: বেলা ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।

কফি হাউস

সেরা বলে যে খাবার বাছা হল: কফি

ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের উদ্যোগে ১৯৪১-৪২ সালে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর কফি হাউস খোলার কিছুদিন পরে ১৯৪২ সালে কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হলে আর একটি কফি হাউস খোলা হয়। পরবর্তীকালে এটি কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস নামে জনপ্রিয়তা পায়। এককালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রধান আড্ডাস্থল ছিল এই কফি হাউস। সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকদের আড্ডা দেওয়ার অবারিত জায়গা হিসাবে এটি খ্যাত। এখনও কফি হাউস তার ঐতিহ্য বজায় রেখে চলছে। কফির গুণগত মান অটুট আছে। কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিট আজ সমার্থক। কলেজ স্ট্রিট যেমন বইয়ের সূতিকাগার, তেমনি কলেজ স্ট্রিটের প্রাণ এই কফি হাউস।

 

১৩. সাবির হোটেল (১৯৪৮)
রেজালার স্বাদ যাদের অনন্য। এর ঠিকানা: ৩ ও ৫ বিপ্লবী অনুকুল চন্দ্র স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০৭২ (চাঁদনি চকের কাছে) খোলা থাকে: বেলা ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত।

সাব্বির হোটেলের রেজালা

সেরা বলে যে খাবার বাছা হল: রেজালা
ধর্মপ্রাণ মুসলিম হাজি সাবির আলি ১৯৪৮ সালে চাঁদনি চকে চালু করেন এই খাবার দোকান। তখন হোটেলটি ছোট ছিল আর রসুইখানা ছিল সামনের দিকে। প্রচুর সংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাদের একটা প্রধান আড্ডার ঠেক ছিল এই সাবির হোটেল। মুঘল হেঁসেল থেকে ‘রেজালা’ নামের খাবারটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে তার সেই আদি রেসিপি আর নেই।
কলকাতার রেজালা ঘরানা আবিষ্কর্তা এই হাজি সাবির আলি। এই হোটেলেই তিনি সেই জাদু খাবার বানান। সাদা ঝোলের ঘি, পেঁয়াজ আর বিভিন্ন মসলা সহযোগে খাসির সিনার মাংস দিয়ে তৈরি হয় এই রেজালা। হলুদ থাকে না, থাকে শুকনো লঙ্কা। এদের বিরিয়ানিও ভাল। বেশ ঝরঝরে ও রঙহীন। খেতে পারেন শাহি টুকরা ও ফিরনি। কাবাব ও রোলও মিলবে। রমজান মাসে মেলে হালিম। হোটেলের দোতলা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত।

 

১৪. কোয়ালিটি রেস্টুরেন্ট
এদের খাবার যে দীর্ঘ সময় ধরে কোয়ালিটি ধরে রেখেছে তার প্রমাণ তো হেরিটেজে স্থান করে নেয়া। এর ঠিকানা: ১৭, পার্ক স্ট্রিট, গ্রাউন্ড ফ্লোর, কলকাতা ৭০০ ০১৬ (পার্ক হোটেলের নিচে) খোলা থাকে: বেলা ১০টা থেকে রাত ১১.৩০ পর্যন্ত।

পাঞ্জাবী/উত্তর ভারতীয় খাবার

সেরা বলে যে খাবার বাছা হল: পাঞ্জাবী/উত্তর ভারতীয় খাবার
জিভে জল আনা উত্তর ভারতীয়, মুঘলাই ও কন্টিনেন্টাল খাবারের জন্য বিখ্যাত এই রেস্টুরেন্টটির অবস্থান কলকাতার খুব সুন্দর জায়গায়। তাই খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন। এদের উত্তর ভারতীয় খাবারগুলির মধ্যে পিন্ডি চানা, কুলচা, ছোলা বাটুরা, চিকেন ভর্তা, ফিস ওরলি, নান ভাল লাগবে। অথচ শুরুতে এই খাবার দোকানে শুধু চা ও স্ন্যাক্স মিলত। পরবর্তীকালে ঘরে তৈরি আইসক্রিম বিক্রি শুরু হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন