এনভারস এ মঁমার্ত ও ফুটবল বিস্ময় আইয়া ট্রোর (পর্ব-৩)

মাসুদুল হাসান রনি

 

বিশ্বের সৌন্দর্য ও আধুনিক নগরীর মধ্যে অন্যতম ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। বর্তমানে সভ্যতার মাপকাঠিতে ফরাসীদের তুলনা হয় না। সারা বছর এই শহরে প্রায় তিন কোটি পর্যটক আসা যাওয়া করেন। পর্যটকদের কাছে নানান কারনে শহরটি প্রিয়। এদের কারও কাছে এই শহর ‘সিটি অফ লাইট। কারও কাছে ‘সিটি অফ লাভ’৷ কারও কাছে সিটি অফ পোয়েট্রি। কারও কাছে সিটি অফ বিউটি। কারও কাছে সিটি অফ কালচার। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে প্যারিস আমার কাছে স্বপ্নের শহর, সিটি অফ ড্রিম। এই স্বপ্নের শহরে আমার বারবার আসা যাওয়া। প্যারিস ভ্রমনের নানান সময়ে নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। পরিচিত হয়েছি অসংখ্য অখ্যাত কুখ্যাত বিখ্যাত মানুষজনের সাথে। এখানে অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে সমৃদ্ধ করেছে!

প্যারিস মানেই তো ল্যুভর মিউজিয়াম , আইফেল টাওয়ার, অপেরা হাউস, ম্যঁলা রুজ, বাস্তিল দুর্গ, প্যারিস গেট, শঞ্জেলেসি, এনভারস এ মঁমার্ত, পার্লামেন্ট হাউস, নটরডেম গীর্জা, নেপোলিয়ন সমাধিস্থল, রিপাবলিক স্কোয়ার বা নিদেনপক্ষে পৃথিবী বিখ্যাত লিডো ডান্স দেখতেই সকলে হামলে পড়েন।প্যারিসে আমার প্রিয় একটি স্থান এনভারস এ মঁমার্ত।যখনই প্যারিস এসেছি একবার হলেও এনভারসে ঢুঁ মেরেছি । পাহাড়ি ছোট টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছে স্যাক্রে-কোয়েউরের বেসিলিকা নামের চার্চ। প্রায় ২৫০ ফিট উঁচু। অনেক বড় জায়গা নিয়ে অবস্থিত। চার্চের পাদদেশে হেঁটে যেমন উঠা যায়, তেমনি রোপওয়ে ক্যাবল কারে উঠা যায়। সারাদিনই পর্যটকদের আনাগোনা। কিন্তু বিকেলের নরম মোলায়েম আলোয় যেন মানুষের ঢল নামে, মেলা বসে। এনভার্সের ওপর থেকে একনজরে পুরো প্যারিস দেখা যায়। শহর দেখার জন্য কয়েক গজ পরপর দুরত্বে দূরবিন রয়েছে। সিঁড়ির নীচে খোলাচত্বরে কেউ একা অথবা দু'তিনজন মিলে বাদ্যযন্ত্র বাঁজিয়ে গান গায়। চার্চের সিঁড়িতে বসে আমি,সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার, আবার কখনো প্যারিস ঘুরতে আসা সাংবাদিক শহিদুল ইসলাম, এনায়েত হোসেন সুহেল, আমার কাজিন বাবুসহ কত যে গান শুনেছি! কত রাত্রি যে ঘন্টার পর ঘন্টা গান শুনে, ড্যান্স দেখে কাটিয়েছি!

এনভার্সের ওপর থেকে একনজরে পুরো প্যারিস দেখা যায়।

স্যাক্রে-কোয়েউরের বেসিলিকা নামের এই বিশাল সাদা গীর্জাটি পাহাড়ের ওপরে। পাহাড়ের নীচে রয়েছে বুলেভার্ড দ্যু ক্লিসি। দু'পাশে অসংখ্য বার,রেস্তোরাঁ, স্যুভেনিয়র শপ ও তুর্কী কাবাবের দোকান। হেঁটে গেলে একটু পরপরই দেখা মেলে সেক্সশপ ও স্ট্রিপ ক্লাবের। দ্যু ক্লিসির ওপরে মেট্রোস্টেশন ব্লোনচে এবং আনভার্স। এই দুই মেট্রোস্টেশন হতে হেঁটে পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে সহজেই এনভার্স এ মঁমার্ত চলে আসা যায়। দিনেরবেলা এনভার্স জমজমাট থাকে পর্যটক ও স্থানীয়দের পদচারনায়। দু'পাশের দোকানগুলোতে সস্তায় কেনাকাটা করা যায় বলে সবসময় ভীড় লেগে থাকে। দোকানগুলোতে গৃহস্থালীর জিনিস, জুতা, সেন্ডেল, পারফিউম হতে শুরু করে সবধরনের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে সস্তায় কেনাকাটার জন্য তাতি'র মতন বেশ কিছু বড় বড় দোকান।একটু হেঁটে গেলে চোখে পড়ে পুরো রাস্তা জুড়ে একটি সুন্দর বিল্ডিং।

দু'পাশের দোকানগুলোতে সস্তায় কেনাকাটা করায় যায়

এলিসিস মন্টমার্টে থিয়েটার। বলা হয়, এটি প্যারিসের সবচেয়ে পুরানো ক্যান ড্যান্স থিয়েটার। বিগত শতাব্দীতে ফ্রান্সে বাস করা বেশিরভাগ খ্যাতিমান শিল্পী ও লেখক একসময় এনভার্সে বাস করতেন। এনভার্স ঘুরে দেখার চেয়েও আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতন টেনে নিত আইয়া ট্রোর। গিনিতে জন্ম নেয়া আফ্রিকান এই তরুন ফুটবল নিয়ে যে শাররীক কসরত দেখায় তা বিস্ময়কর। ছবি দেখে বোঝা যাবে না এই আফ্রিকান তরুন কতটা অনবদ্য শাররীক কসরতের মাধ্যমে ফুটবলকে নিয়ে ভারসাম্যের ছেলাখেলা খেলেন। ইউটিউবে অনেকেই তাঁর হাজার হাজার ভিডিও দেখেছেন।তারা হয়ত কিছুটা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন তাঁর নৈপুণ্য কোন মাত্রার।আইয়া ট্রোর সাথে আমার প্রথম দেখা ২০১১ সালে এনভার্সে। সেদিন প্রচুর ভীড় থাকায় তাঁর সাথে কথাবলা দুরের কথা, সামনে যেতেই পারিনি। পরের বৎসর আবার এনভার্সে তাঁর ফুটবলের জাদু দেখে ভীড় ঠেলে কাছাকাছি চলে যাই। হ্যান্ডশেক করা ছাড়া হ্যালো পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ছ'মাস পর আবার প্যারিস গেলে রোখ চেপে যায় এবার তার সাথে কথাতো বলবোই এবং ছবিও তুলবো। হ্যাঁ এবার আমি আর ব্যর্থ হয়নি। একঘন্টা জাদু দেখিয়ে আইয়া যখন ঘামার্ত শরীর নিয়ে নীচে নেমে আসে তখনই সুযোগটি নেই।

আইয়া ট্রোর সঙ্গে লেখক

মানুষের ভীড় ঠেলে "হ্যালো আইয়া " বলতে সে চমকে উঠে।সাধারনত কেউ তাঁর নাম ধরে ডাকে না। হয়ত কেউ নাম জানে না। আমার ডাক শুনে আইয়া অবাক হয়ে জিগেস করে, তুমি কি আমাকে চেনো?কেন নয়। আমি গত তিনবছর নিয়মিত এখানে এসেছি তোমার নৈপুণ্য দেখতে। বলতে পারো আমি তোমার ফ্যান হয়ে পড়েছি।এবার আইয়া একটু লজ্জা পেয়ে যায়। ঘামে ভেজা গেঞ্জি পাল্টে পানির বোতল নিয়ে সিঁড়িতে এসে বসে। আমি কোথা থেকে এসেছি, তাঁর নাম জানি কিভাবে জানতে চায়। আমি সহজ পথে না গিয়ে বলি, তোমাদের একসময়ের প্রেসিডেন্ট আহমেদ সেকাতুরে অনেকবার আমার দেশে গিয়েছেন। তখন থেকে তোমার দেশ গিনিকে চিনি। আর তোমাকে এখন কে না চেনে? আইয়া আমার কথা শুনে লাজুক হাসে। আমি জানি একটু পর ওকে পাবো না। আবার জাদু দেখাতে পোলের ওপর উঠে যাবে। তাই সময় নস্ট না করে ওর সাথে দু'চারটে ছবি তুলে ফেলি।

আইয়া ট্রোর ফুটবল নিয়ে শাররীক কসরতের বিস্ময়

আইয়া ট্র্যোর জন্ম ১৯৮৬ সালে। গিনির এই ফুটবলার তিনবার গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছেন। বাবার হাত ধরে প্যারিস আসা। বর্তমানে আইয়া প্যারিসের অন্যতম সেলিব্রেটি। টিভি শো, রিয়েলিটি টিভি শো, মিউজিক ভিডিও এবং বিজ্ঞাপনে তার সরব উপস্থিতি। আইয়া গিনির কেবিয়া গ্রামে স্থানীয় গোলকিপার হিসাবে খেলা শুরু করেছিলেন। পরে গিনির রাজধানী কোনাক্রিতে তিনি ফুটবল ক্লাব ইব্রাহিম এফসিতে যোগ দিয়েছিলেন। ২০০০ সালে আইয়া ট্রোর প্যারিসে এসে ইএসপি , প্যারিস এফসি , প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে ফুটবল খেলেন। পেশাদার ফুটবলে সুবিধা করতে পারেননি বলে জীবন জীবিকার জন্য বেঁছে নেন ফুটবল নিয়ে শাররীক কসরত প্রদর্শন করা।

প্রতিদিন বিকেল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এনভার্সের স্যাক্রে-কোয়েউরের বেসিলিকা গীর্জার সামনে ফুটবলের জাদু দেখিয়ে হাজার হাজার দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করেন।২০১৪ সালে আইয়া ব্রাজিলের বিশ্বকাপের জন্য শাকিরার লা লা লা মিউজিক ভিডিওতে পারফর্ম করেছেন। চীন, ফ্রান্স, ঘানা, মিশর, মরক্কো, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিলসহ ৪০ টিরও বেশি দেশ তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি করেছে।সারাবিশ্বে অাজ আইয়া ট্রোর ফুটবল নিয়ে শাররীক কসরতের বিস্ময়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন