ইংলিশ চ্যানেলের কোল ঘেঁষে যে শহর

শোয়ায়েব চমক

সম্প্রতি গাড়ি চালানো শিখেছি। যতটা সহজে বলছি, কাজটা ইংল্যান্ডে ততটা সহজ না। ইংল্যান্ডে ড্রাইভিং পরীক্ষা দেয়া আর আমাদের এখানকার মেট্রিক পরীক্ষা দেয়া একই কথা। সবশেষে লাইসেন্স হাতে পেয়ে মনে হল, এইবার ঠেকায় কে!!! গাড়ি নিয়ে ছুটে চলব অজানায়।  সেই লক্ষ্যেই পরিবারকে গাড়ির পেছনে নিয়ে ইংল্যান্ডের এক অজানা অচেনা শহরের দিকে রওনা হলাম। জায়গাটি ছিল দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ইস্ট ডেভন এলাকার ছোট্ট সমুদ্র নিকটবর্তী শহর সিটন। সিটন লন্ডন থেকে চার ঘন্টার ড্রাইভ। কোন ঝামেলা ছাড়াই ইস্ট ডেভন এলাকায় ঢুকে গেলাম। গাড়ির নেভিগেশন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে হাইওয়ে ছেড়ে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে। কখনওবা বনের ভেতর দিয়ে। যতই প্রবেশ করছি ততই বৃষ্টিভেজা ইস্ট ডেভনের সৌন্দর্য চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। ইংলিশ চ্যানেলের ধার ঘেঁসে অবস্থিত সিটন শহরে মাত্র আট হাজার চারশো লোকের বাস। মাছ ধরা এবং চাষাবাদ এই দুটিই শহরের বাসিন্দাদের মূল জীবিকা।  যদিও বলছে এই এলাকাটি একসময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রোমান সাম্রজ্যের সময় সিটনেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর। এখানকার সিটন ডাউন, হকস ডাউন হিল, ব্ল্যাক বেরি ক্যাম্প এবং বেরি ক্যাম্প এলাকায় রোমানদের তৈরি বিভিন্ন দুর্গ এর প্রমাণ। রোমানদেরও চার হাজার বছর আগ থেকেই এখানে মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। স্যাক্সন আমলে এই শহরের নাম ছিল ফ্লিট। স্যাক্সনরা ১০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এখানে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ১১৪৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ইউজিনিয়াস এই শহরের নাম রাখেন সিটন। 

সিড মাউথ এর সমুদ্র সৈকত

এরপর বেশ কয়েক শতাব্দী ধরেই সিটন গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর হিসেবে ব্যাবহৃত হয়ে আসছিল। বিশেষ করে রাজা প্রথম অ্যাডওয়ার্ডের সময় স্কটল্যান্ড এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালীন সময় জাহাজ এবং নাবিক সরবরাহের জন্য সিটন বন্দর ব্যবহৃত হতো। এরপর ১৮৬৮ সালে এই শহরে রেলপথের আগমনে ধীরে ধীরে বন্দরের গুরুত্ব কমতে থাকে। ২০১৩ সালে সৌখিন প্রত্নতাত্ত্বিক লরেন্স এগারটনের অবিষ্কার নতুন করে সিটনকে আলোচনায় নিয়ে আসে। তিনি মেটাল ডিটেকটরের মাধ্যমে সিটন ডাউন হর্ড-এর খোঁজ পান। সেখানে তিনি ২২,০০০ রোমান মুদ্রা আবিস্কার করেন যা কিনা চতুর্থ শতাব্দীর বৃহত্তম এবং ব্রিটেনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইতিহাসের পাতা থেকে ফিরি বাস্তবে। গাড়ি চালিয়ে ভালভাবেই সন্ধ্যের দিকে সিটনে বন্ধুর বাসায় পৌঁছালাম। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে হালকা চা নাস্তা সেরে বন্ধুর সঙ্গে বের হলাম শহর ঘুরতে। ফেব্রুয়ারির কনকনে শীতে হাঁটার চেয়ে গাড়ি করে ঘুরে বেড়ানোই আরামদায়ক মনে হলো। ভাবতেই ভাবতেই খেয়াল করলাম, চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে বলে বিশেষ কিছু দেখার নেই। বন্ধু সিদ্ধান্ত বদলে আমাকে নিয়ে গেল পাশের একটি গ্রামে। এই গ্রামের নামটি আমাদের অতি পরিচিত একটি পানীয়ের নামে। বলেই ফেলি গ্রামটির নাম বিয়ার। চমৎকার ছোটখাটো, ছিমছাম গ্রাম। রাতের অন্ধকারেও বেশ ভাল লাগল। বিয়ারের জনসংখ্যা মাত্র ১৩১৭। 

ব্রাঞ্চকম্বি

রাতে ঘুমিয়ে পরদিন বের হলাম শহর ঘুরতে। গেলাম সিডমাউথ, ব্রান্সকমবে বিয়ার, ওয়েস্টন, সালকমবে রিগস। এরমধ্যে সিডমাউথ হচ্ছে শহর আর বাকিগুলো গ্রাম। ইস্ট ডেভনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে সুনাম এতদিন শুনে এসেছি তার স্বাদ পেলাম এই গ্রামগুলো ঘুরে। এর মধ্যে বাচ্চাদের জন্য কিছু খাবার কেনার জন্য গেলাম স্থানীয় সুপার মার্কেটে। সেখানে আমার স্ত্রী একজনকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা তোমাদের এখানে হালাল মাংসের এরিয়া কোনটা? সে কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল, What is Halal ? আমার স্ত্রী বোঝানোর চেষ্টা করলেন, হালাল বুঝতে পারছেন না, ওই যে মুসলিমরা খায়। ইংলিশ বেচারা বারবার মাথা নেড়ে বলে এই শব্দ সে জীবনে শুনেনি।

সিটনের একমাত্র বাঙালী রেস্টুরেন্ট, রাগিনী

বাসায় এসে বন্ধুকে বলতেই ‘হেসে বলল, আরে মিয়া এই এলাকায় আমরাই একমাত্র মুসলিম পরিবার। আমার একার লাইগা কি আর এরা হালাল জিনিস রাখবে!! আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তাহলে তুমি হালাল মাংস কোথা থেকে আনো। সে হেসে বলল, ৫০ মিনিট ড্রাইভ করে বড় শহর এক্সেটার থেকে আনি। সেখানে তার্কিস কিছু দোকান আছে। তাছাড়া সেখানে কিছু মাংসের সাপ্লাইয়ার আছে তাদের কাছ থেকে আনি।  যা হোক তিনদিন বন্ধুর বাসায় থেকে ডেভনের সৌন্দর্য উপভোগ করে লন্ডনে নিজের ডেরায় ফিরে এলাম। এখানে অবাক চোখে কেউ বলেনা, ‘ What is Halal. ’

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন