অপমানের বদলা নিতেই নির্মিত হয়েছিল রোজ গার্ডেন

দূরবীন

ঢাকার কে এম দাস লেন, টিকাটুলি এলাকায় অবস্থিত রোজ গার্ডেন স্থাপত্যের এক বিষ্ময়। এককালে ঢাকার যে কয়টি স্থাপনা নিয়ে মানুষ গৌরব করতো তার প্রথমদিকেই ছিল এটি। যদিও আজ আর তা নেই। বর্তমানে মূল ভবনটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এক সময় যে খোলা জায়গায় ছিল গোলাপ বাগান। আজ সেসব জায়গায় ওঠেছে অন্তত ডজন খানেক অ্যাপার্টমেন্ট। তবুও কোন পর্যটক মন এক ফাঁকে ঘুরে আসতে পারেন রোজ গার্ডেন চত্বরে। এ বাড়ি তৈরির পেছনে রয়েছে এক অভিমান। যে অভিমান হৃষিকেশ দাসকে এ ভবন নির্মাণে জেদি করেছিল। তা হলো বলধা গার্ডেনের স্রষ্টা নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর হৃষিকেশকে ফিরিয়ে দেয়া।

১৯২০-৩০ এ সময়কালে বলধা গার্ডেনে বসত জলসা। কোন এক সন্ধ্যায় হৃষিকেশ তা উপভোগ করতে চাইলে তাকে বের করে দেয়া হয়। আর এই অপমানই তাকে বাধ্য করেছিল রোজ গার্ডেন তৈরিতে। অবশ্য এর ব্যয় বহন করতে গিয়ে চড়া মূল্য দিয়ে হয়েছে হৃষিকেশকে। খুব বেশিদিন তিনি এই বাড়িটি ভোগ করতে পারেননি। ভোগ করেছিলেন মাত্র ছয় বছর। ১৯৩০-এ বাড়ি নির্মাণ। বিক্রয় করেছিলেন ১৯৩৬-এ। বন্ধু কাজী আবদুর রশীদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছিলেন ছয় বছর পর। সর্বস্বান্ত হয়েছেন হৃষিকেশ। তবুও পরাজিত হননি নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বলধের কাছে। বলধা গার্ডেনের বিপরীতে কালের তিলক হিসেবে তৈরি করেছিলেন রোজ গার্ডেন। ঢাকার টিকাটুলী বা হাটখোলাতে বাইশ বিঘা (৭ একর) জমির ওপর তৈরি করেন বিশাল অট্টালিকা। হাজার হাজার গোলাপের চারা রোপণ করলেন। গড়লেন ঢাকার সবচেয়ে বড় গোলাপ বাগান। কাটালেন পুকুর। বানালেন শিল্পীর হাতে বেশ কিছু মর্মর পুতুল। ধীরে ধীরে এভাবেই গড়ে ওঠে ‘রোজ গার্ডেন’।

চারপাশে সীমানা জুড়ে আম গাছের সারি। এর মাঝখানেই নির্মিত হয় কারুকার্যময় গ্রিক স্থাপত্যের ধাঁচে অনন্য নিদর্শন জাঁকালো এক ভবন। শুরুর কিছুদিন পর জলসাও শুরু হয়। সন্ধ্যা হলেই বসত আলোর মেলা। হতো গানের আসর। বয়ে যেত হাসির হল্লা। খুব বেশিদিন টিকল না। জাঁকজমক আর জলুস প্রদর্শন করতে গিয়ে হৃষিকেশ ব্যবসায় মনোযোগ দিতে পারেননি। ধীরে ধীরে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। একসময় জেদে গড়া সোনার মহলও ছাড়তে হলো। নবাবের বন্ধু ও ব্যবসায়ী কাম জমিদার কাজী আবদুর রশীদের কাছে হৃষিকেশ বিক্রি করে দিলেন ‘রোজ গার্ডেন।’ এভাবেই বিলুপ্ত হয় হৃষিকেশ অধ্যায়। সূচনা ঘটে ‘রশীদ মঞ্জিল’-এর। কাজী আবদুর রশীদ মারা যান ১৯৪৪ সালে। তার মৃত্যুর পর রোজ গার্ডেনের মালিকানা পান তার বড় ছেলে কাজী মোহাম্মদ বশীর (হুমায়ুন সাহেব)।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ১৯৭০-এবেঙ্গল স্টুডিও ও মোশন পিকচার্স লিমিটেড রোজ গার্ডেন প্যালেসের ইজারা নেয়। হারানো দিন নামের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের শুটিং এই বাড়িতেই হয়েছিল। এ কারণে সে সময় ভবনটি ‘হুমায়ুন সাহেবের’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৯ সালে বাড়িটিকে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করে। ২০১৯ সালে বাড়ির মূল স্থপনাটি সরকার কিনে নেয়। বর্তমানে সেখানে একটি জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। বেশকিছু মজার ঘটনাও আছে এ বাড়ি ঘিরে। এ ভবনে ভাসানী বোরকা পরে ঢুকেছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে এই ঘটনা ঘটেছিল। তখন চারপাশে প্রচন্ড ধর-পাকড় থাকায় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাঁধার মুখে পড়তে পারেন এমন প্রচারে ভাসানী কৌশল হিসেবে ছদ্মবেশে বোরকা পরে টমটমে চড়ে রোজ গার্ডেনে পৌঁছান।

১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন রোজ গার্ডেনে যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল, সেটিই নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়েছে। সময়সূচি: রোজ গার্ডেন দেখতে হলে ছুটির দিন বাদে অন্য যে কোন দিন যেতে হবে। প্রবেশের জন্য কোন ফি দিতে হয় না। তবে মূল ভবনে প্রবেশের আগে অনুমতি নিতে হয়। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫ পর্যন্ত রোজ গার্ডেন খোলা থাকে। কিভাবে যাবেন: গুলিস্থান বা যাত্রা বাড়ী থেকে রিকশায় করে সরাসরি রোজ গার্ডেনে যাওয়া যায়। তবে লেগুনা বা বাসে করে আসলে টিকাটুলি রাজধানী সুপার মার্কেট মোড়ে নামতে হবে। এরপর হেটে বা রিকশায় রোজ গার্ডেনে যাওয়া যায়। অনেক রিকশাওয়ালা রোজ গার্ডেন বললে নাও চিনতে পারে। হুমায়ুন সাহেবের বাড়ী বললে সহজে চিনতে পারবে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন
Please log in to share your opinion

Related Posts

আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন