দিবাকর
চীনে যাচ্ছি। সবকিছুই ঠিক। যারা নিয়ে গেছে সেই কনফুশিয়াস ইনস্টিটিউট জানতে চেয়েছে পছন্দ কি? কি খেতে চাই? কি খাবো না? চাইনিজ ভাষায় ফোনে তাই লাওশি ভাঙা ভাঙা গলায় জানতে চাইলেন ‘নো বিফ, নো পর্ক।’ আমি বললাম, ‘আই লাইক ভেজিটেবল। আই লাইক চিকেন। নো প্রবলেম।’ তবু দ্বিধা তো রয়েই গেল। শুনেছি চীনারা সাপ-ব্যাঙ-শামুক সবই খায়। ওদের হালাল-হারাম বলে কোনো বিষয় নেই। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঁয়তাল্লিশ জন শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই বিফ আর চিকেন লিখে দিয়েছি ফরমে। আমাদের সহযাত্রী আলোকচিত্রী কামাল ভাই (চাইনিজ নাম মাথাও বলে পরিচিত) এর আগেও কুনমিং গিয়েছেন। অভিজ্ঞ মানুষ। পরামর্শ করলাম জরুরি কী কী নেয়া দরকার। তিনি বললেন, কী নেন আর না নেন তবে এক প্যাকেট চিড়া আর গুড় অবশ্যই সঙ্গে নেবেন। এটা খুব কাজে দেবে।
আমি বললাম কি বলেন? চিড়া-গুড়! খুলে বলেন ঘটনা কি? বেশ ক’টা কারণেই নেয়া ভালো। এক. চীনাদের খাবার-দাবার বিশেষ করে যে মসলা তা আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। অনেক রকম সবজি সেদ্ধ পাবেন টেবিলে। আর কুনমিং আমাদের চেয়ে দুই ঘণ্টা আগে। সুতরাং যখন সকাল সাতটায় ওদের ব্রেকফাস্ট টাইম। আমাদের এখানে তখন ভোর পাঁচটা। দুপুর ১১টায় ওদের লাঞ্চ টাইম, ১২টার মধ্যে শেষ। তার মানে আমাদের এখানে তখন সকাল দশটা। আমাদের অনেকে এ সময় নাস্তা পর্যন্ত শুরু করে না। অন্যদিকে ওদের ডিনার বিকাল পাঁচটা থেকে ছয়টা আমাদের এখানে তখন দুপুর ঠিক ৩টা। সমস্যা হবে রাতে। এত আগে ডিনার করে লম্বা সময় আর খাওয়া নেই। ক্ষুধা লাগতে পারে। সুতরাং তখন একমুঠো চিড়া আর গুড় আপনার পাকস্থলিতে প্রশান্তি দিতে পারে। মনে হলো, ভালোই তো বুদ্ধি। কিন্তু চীন যাব চিড়া নিয়ে? আমার বাসায় সব জানালে অবাক হলেও যুক্তিটা মেনে নিলো। পরে যাবার আগের দিন আমার ট্রলি ব্যাগে দেখলাম ঠিকই ঘরণী ঠিকই এক প্যাকেট চিড়া দিয়ে দিয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত দু’সপ্তাহ অবস্থানকালে কুনমিং-এ খাবার নিয়ে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি।
আয়োজকরা আমাদের কথা মাথায় রেখে সব সময় প্রতিটি ভিজিটিং প্রোগ্রামে হালাল খাবার রেখেছেন। সারাদিন বাইরে থাকার সময় চিকেন বার্গার, চিকেন নাগেট আর কোক থাকতো আমাদের জন্য। আর তিনবেলা খাবারের মধ্যে সবচেয়ে রাজসিক খাবার পেতাম নাস্তার টেবিলে। ম্যাপল প্যালেস উদারভাবে আমাদের নানান পদ সরবরাহ করতো। স্যুপ, চা, কফি, দুধ থেকে শুরু করে অন্তত তিরিশ রকমের খাবার সাজিয়ে রাখতো। কাজেই পুরোদিন আর কোথায় কি খাওয়া হচ্ছে না ভেবে আমরা সকলেই উদরপূর্তি করে ফুর্তিতে বের হতাম। সকালের খাদ্য তালিকায় ম্যাপল কর্তৃপক্ষ একেক দিন একেক ধরণের মজাদার সব খাবার সরবরাহ করতো। শখ করে একদিন সেই খাদ্য তালিকার নোট নিয়েছিলাম। চালের তৈরি স্যুপ, ফল মিশ্রিত চালের স্যুপ, গাজর, পদ্মফল সেদ্ধ, সালাদ, শসার তৈরি সালাদ,মাশরুম সহযোগে সবজি সেদ্ধ, চিকেন রাইস,লবণ মরিচে তৈরি আলুর চিপস, মিষ্টি পানিতে ভুট্টা সেদ্ধ, মিষ্টি আলু সেদ্ধ, গাজর ও শসা সেদ্ধ,এক ধরনের রুটি,গাজর ও বাঁধাকপি পাতা সেদ্ধ, বরবটি সেদ্ধ, সবজিসহ নুডুলস সেদ্ধ, বার রকমের মসলা সহযোগে রাইস নুডুলস, মটরশুটি সেদ্ধ, চিকেন রাইস মিক্সড করে ভাজা, সুইট কর্নফ্লেক্স এবং নন-সুইট কর্নফ্লেক্স। এর বাইরে ডিম থাকতো তিন ধরনের। সাধারণ ডিম পোচ-এর বাইরে থাকতো রাজহাঁসের ডিম আর সাধারণ মুরগির ডিম সেদ্ধ। দুধ দুই ধরনের সয়া আর সাধারণ। জুস দুই তিন ধরনের। এর বাইরে রুটি, মাখন, জেলি তো ছিলোই।
দিন এবং রাতে আমাদের লাঞ্চ-ডিনারের ব্যবস্থা ছিল ইউনান ইউনিভার্সিটির ওয়েতং ক্যাফেটরিয়ায়। সেখানকার তিন তলায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি হালাল ফুডের কর্ণার ছিল। দুপুর এবং রাতে বিশ রকমের আইটেম থাকতো। এরমধ্যে বিফ, চিকেন আর ভেজিটেবল দিয়ে তৈরি নানান পদ ছাড়াও কখনো কখনো মাছ ভাজি বা মাছ অল্প মসলায় সেদ্ধ করে পরিবেশন করতে দেখেছি। চীনে গিয়ে খাবারের তালিকায় সবচেয়ে বেশি দেখেছি আলু দিয়ে তৈরি নানান রকমের পদ। সব রকম আলুর ব্যবহার তারা খাবারে করে থাকে। মিষ্টি আলু সেদ্ধ, পোড়া, অল্প তেলে ভাজা সবরকম। আলু সেদ্ধ, আলু বড় করে ভাজি, আলুর চিপস প্রতিদিনই কোনো না কোনো পদ পেতাম। আর পেতাম ভুট্টা দিয়ে নানান রকম খাবার। ভুট্টা চিনি দিয়ে ভাজা, ভুট্টা সেদ্ধ, ভুট্টা চিনি পানিতে সেদ্ধ, ভুট্টা ফ্রুট সালাদের সঙ্গেও ব্যবহার করতে দেখেছি। টেবিলে প্রচুর তরমুজ সরবরাহ করতে দেখেছি। চীনে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি খাবারের সঙ্গে পানি পরিবেশন না করা। চীনারা পানি কম খায়। হয়তো আবহাওয়া ঠাণ্ডা বলে। আর বাইরে দোকানগুলোতে খেয়াল করেছি পানির চেয়ে সেখানে বিয়ার সস্তা। যেখানে তিন বা চার আরএমবিতে বিয়ার পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে পানি বা কোক কিনতে পাঁচ বা ছয় আরএমবি।
সন্ধ্যায় ম্যাপল প্যালেসের উল্টোদিকে পাঁচতলা একটি মলে তরুণ-তরুণীরা দলে দলে বসে আড্ডা দিতো। তাদের টেবিলে একটি বড় পাত্রে গরম গরম নুডুলস পরিবেশন করতে দেখেছি। সবাই মিলে তা চপস্টিক দিয়ে খেতো। আর প্রচুর ভাজাভুজি বা কাবাব বিক্রয় হতো। সেখানে অক্টোপাস থেকে শুরু করে নানান ধরনের মাছ, সবজি, পোকামাকড় ভাজি বিক্রয় হতো। নানান মসলা সহকারে এই খাবারে রশনা তৃপ্ত করতো চায়না যুব সমাজ। তেষ্টায় তাদের হাতে থাকতো বিয়ার। এতো গেল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু অথেনটিক চাইনিজ ফুড কি? আমরা যে চাইনিজ খাবার খাই তা কি সত্যিই চাইনিজ। আসলে এটা একটা বুজরুকি। আমরা যে চাইনিজ খাবার খেয়ে থাকি তা নামেই। এটা বাংলাদেশি সংস্করণ। চীনের রাইস নুডুলস আমাদের এখানে আমি তৈরি হতে দেখিনি। চীনারা যেভাবে মাছ কাবাব করে বা বেগুন পুড়িয়ে ফুটপাথে বিক্রয় করে তা আমাদের এখানে সম্ভব নয়। দেশে ফিরে বেশকিছু চাইনিজ খাবার তৈরির চেষ্টা করেছি খুব একটা পেরে উঠিনি।